পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬০২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

নহে। সুতরাং তাহারা তখন হইতেই ইহার প্রতিশোধ লইবার সুযোগ খুঁজিতে লাগিল। শেষে একদিন, পরশুরাম আর তাঁহার চারি ভাই আশ্রম হইতে বাহির হইয়া গেলে, দুষ্টেরা খালি আশ্রম পাইয়া, বাঘের মত আসিয়া জমদগ্নিকে আক্রমণ করিল। জমদগ্নি প্রহারের যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া, কাতরভাবে 'হা রাম’! বলিয়া কতই চিৎকার করিলেন, দুরাত্মাগণের তথাপি দয়া হইল না।

 এইরূপে সেই দুষ্টেরা জমদগ্নিকে হত্যা পূর্বক সেখান হইতে প্রস্থান করিবার কিঞ্চিৎ পরেই পরশুরাম আশ্রমে ফিরিয়া আসিলেন। আশ্রমের আঙ্গিনায় প্রবেশমাত্রই তিনি দেখিলেন, সেখানে রক্তের স্রোত বহিতেছে, আর তাহার মধ্যে তাঁহার পিতার দেহ শত অস্ত্রের ঘায় ক্ষতবিক্ষত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। তখন যে তাহার প্রাণে কি দারুণ কষ্ট হইল, আর কিরূপ কাতরভাবে তাঁহার পিতার গুণের কথা বলিয়া তিনি ক্রন্দন করিলেন, তাহার বর্ণনা আমি কি করিব! কাঁদিতে কাঁদিতে ক্রমে তিনি রাগের আগুন হইয়া উঠিলেন। এমন রাগ বুঝি বা এ পৃথিবীতে আর কাহারো হয় নাই।

 জমদগ্নির দেহ পোড়ানই অবশ্য এ সময়ে পরশুরামের প্রথম কর্তব্য হইল। সে কাজ শেষ হইলে, তিনি ধনুর্বাণ এবং ভীষণ কুঠার হস্তে সাক্ষাৎ মৃত্যুর ন্যায়, কার্তবীর্যের পুত্রগণের প্রাণবধ করিতে বাহির হইলেন। অল্পকালের ভিতরেই ঘোরতর যুদ্ধে তাহাদের সকলে পরশুরামের কুঠারের ঘায় খণ্ড খণ্ড হইল, কিন্তু তথাপি পরশুরামের রাগ থামিল না। ইহার পর তিনি কার্তবীর্যের বংশের সকল লোক এবং তাহাদের আশ্রিত সকলকে বধ করিলেন, তথাপি তাহার রাগ থামিল না। শেষে ক্ষত্রিয়মাত্রেই তাহার রাগের পাত্র হইয়া দাঁড়াইল।

 যতদিন পৃথিবীতে ক্ষত্রিয় খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন, ততদিন আর পরশুরাম বিশ্রাম করেন নাই। ক্রমে ক্ষত্রিয়ের রক্তে পৃথিবীরময় কাদা হইয়া গেল, ক্ষত্রিয়দের শিশুরা পর্যন্ত পরশুরামের হাতে প্রাণ ত্যাগ করিল;তাহার পর আর ক্ষত্রিয় খুঁজিয়া পাওয়া গেল না! তখন পরশুরামের মনে দয়া হওয়াতে, তিনি দুঃখের সহিত বনে চলিয়া গেলেন।

 বনে গিয়াও পরশুরাম অনেক সময় সেখানকার মুনিদিগের নিকট অহঙ্কার করিয়া বলিতেন, “আমি পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় (ক্ষত্রিয় শূন্য) করিয়াছি।” কিন্তু মুনিরা কেহই তাহার এ নিষ্ঠুর কার্যে সন্তুষ্ট ছিলেন না।

 এই ভাবে একহাজার বৎসর চলিয়া গেল। ইহার মধ্যে ক্ষত্রিয়দের যে দু-একটি শিশু ভগবানের কৃপায় রক্ষা পাইয়াছিল, ক্রমে তাহাদের ছেলেপিলে হইয়া আবার এ পৃথিবী ক্ষত্রিয়ে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। এমন সময় একদিন বিশ্বামিত্রের পৌত্র পরাবসু পরশুরামকে নিন্দা করিয়া কহিলেন, “তুমি যে ক্ষত্রিয় শেষ করিয়াছ বলিয়া এত বড়াই করিয়া থাক, কই! আবার ত দেখিতেছি পৃথিবী ক্ষত্রিয়ে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।

 এ কথায় পরশুরামের সেই নিভানো রাগের আগুন আবার ধু ধু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল! সুতরাং আর তিনি বনের ভিতর চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। তখন আবার ভীষণ কাণ্ড উপস্থিত হইল। আবার ক্ষত্রিয়ের রক্তে পৃথিবী ভাসিয়া গেল। যতক্ষণ একটি মাত্র ক্ষত্রিয়ও খুঁজিয়া পাওয়া গিয়াছিল, ততক্ষণ আর পরশুরাম বিশ্রাম করেন নাই। যখন আর ক্ষত্রিয় পাওয়া গেল না। তখন আর কি করেন? তখন কাজেই তাহাকে থামিতে হইল। কিন্তু তা আর কতদিনের জন্য? যখন আবার ক্ষত্রিয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইল, তখন পরশুরামের