পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৬০৩

রাগও হঠাৎ আবার বাড়িয়া গেল। এমনি করিয়া ক্রমাগত একুশবার তিনি পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয়া করিয়াছিলেন। শেষে ক্ষত্রিয়ের রক্তে সমন্তপঞ্চক নামক তীর্থের পাঁচটি হ্রদ হইয়া গেল, সেই রক্তে পূর্বপুরুষদিগের তর্পণ করিয়া তাঁহার মনে হইল, যেন এতক্ষণে রাগটা একটু কমিয়াছে।

 ক্ষত্রিয়েরাই ছিলেন পৃথিবীর রাজা, সেই ক্ষত্রিয়দিগকে জয় করাতে সমস্ত পৃথিবী এখন পরশুরামেরই হইল। কিন্তু তিনি ত আর রাজ্যের লোভে ক্ষত্রিয়দিগকে বধ করেন নাই, রাজ্যের প্রয়োজন তাঁহার কিছুমাত্র ছিল না। সুতরাং ইহার পর তিনি একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়া সেই যজ্ঞের দক্ষিণা স্বরূপ সমস্ত পৃথিবী মহর্ষি কশ্যপকে দান করিয়া ফেলিলেন।

 পরশুরামের নিষ্ঠুর কার্যে অন্যান্য মুনিগণের ন্যায় কশ্যপও নিতান্ত দুঃখিত ছিলেন। সমস্ত পৃথিবী দক্ষিণা পাইয়া তাহার মনে হইল যে, ক্ষত্রিয়দিগকে রক্ষা করিবার এই উত্তম সুযোগ। এই ভাবিয়া তিনি পরশুরামকে আঙ্গুল দিয়া দক্ষিণে যাইবার পথ দেখাইয়া বলিলেন, “হে মহাপুরুষ! তুমি তবে এখন এই পথে দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে চলিয়া যাও। এ-সকল দেশ ত এখন আমার হইয়াছে। সুতরাং ইহাতে আর তোমার বাস করা উচিত নহে!”

 এ কথায় পরশুরাম আর কিছুমাত্র আপত্তি না করিয়া তখনই দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে চলিয়া গেলেন। সমুদ্র তাহাকে দেখিবামাত্র খানিক দূর সরিয়া গিয়া তাঁহার বাসের জন্য ‘শপাকার’ নামক একটি নতুন দেশ প্রস্তুত করিয়া দিল।

 এদিকে পৃথিবীর নানারূপ দুর্দশা উপস্থিত হইল। ক্ষত্রিয়েরা মরিয়া যাওয়াতে কোথাও আর রাজা রহিল না। কশ্যপ মুনি পৃথিবীকে পাইয়া যদি তাহাতে রাজ্য করিতেন, তাহা হইলেও কতক কাজ হইতে পারিত। কিন্তু তিনি তপস্বী মানুষ, রাজ্য দিয়া তিনি কি করিবেন? যে মুহূর্তে তিনি পৃথিবী দক্ষিণা পাইলেন, তাহাব পর মুহূর্তেই তিনি তাহা ব্রাহ্মণদিগের হাতে দিয়া নিজের কাজে চলিয়া গেলেন। ব্রাহ্মণরা পৃথিবীতে বাস করিয়া মনের সুখে তাঁহাদের জপতপ করিতে লাগিলেন; উহা যে আবার শাসন করিতে হইবে, এ কথা তাহাদের মাথায় আসিল না। এভাবে কিছুদিন চলিলেই দেখা গেল যে, যত চোর ডাকাত, তাহারাই রাজ্যের কর্তা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। চোরেরা নিশ্চিন্তে চুরি করিয়া বেড়ায়, কেহ তাহাদিগকে সাজা দিবার কথা বলে না। ভাল লোকেরা দুষ্ট লোকদিগের ভয়ে সর্বদা শশব্যস্ত থাকে, ধন পাইয়া লোকে এতটুকুও আসা করিতে পারে না যে, আর দু-দণ্ড সে ধন তাহার হাতে থাকিবে। শেষে পৃথিবী আর পাপীদের অত্যাচার সহিতে না পারিয়া রসাতলে (পাতালে) যাইতে আরম্ভ করিলেন। ভাগ্যিস ভগবান কশ্যপ সেই সময়ে তাড়াতাড়ি আসিয়া নিজের উরু দিয়া পৃথিবীকে আটকাইয়া ছিলেন;নহিলে এখন আমরা কোথায় বাস করিতাম?

 কশ্যপ উরু দিয়া আটকাইয়াছিলেন বলিয়াই পৃথিবীর এক নাম হইয়াছে উর্বী। সে যাত্রা পৃথিবী কোন মতে বাঁচিয়া গেলেন, কিন্তু নিজের দুরবস্থার কথা ভাবিয়া তিনি কিছুতেই মন স্থির করিতে পারিলেন না। তাই তিনি অতিশয় বিনয়ের সহিত কশ্যপকে বলিলেন, “ভগবন, আমি কিসের ভরসায় সুস্থির থাকিব? আমাকে কে দেখিবে? রাজারা সকলেই মরিয়া গিয়াছেন, এখন তাহাদের জায়গায় কেহনা আসিলে ত আমি আর উপায় দেখি না। ইহাদের কয়েকজনের সন্তানকে আমি অনেক কষ্টে নানাস্থানে লুকাইয়া রক্ষা করিয়াছি কৃপা পূর্বক তাহাদিগকে আনিয়া রাজা করিলে আমিও রক্ষা পাইতে পারি।”