পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৬২৩

ব্যাকুল হইয়া আমি প্রিয় বন্ধুকে এমন শাপ দিলাম, আমার মত দুঃখী এবং পাপী আর কে আছে?”

 ইহার কিছুদিন পরে, অর্বাবসু ও পরাবসু একটি যজ্ঞ উপলক্ষে কিছুদিনের জন্য বৃহদ্দ্যুম্ন রাজার বাড়িতে যান। সেই সময়ে একদিন রাত্রিকালে কোন কারণে, পরাবসুর আশ্রমে ফিরিয়া আসিবার প্রয়োজন হয়, রৈভ্য যে তখন কৃষ্ণাজিন (কাল হরিণের ছল) গায় দিয়া বাহিরে নিদ্রা যাইতেছিলেন, পরাবসু তাহা জানিতেন না। অন্ধকার রাত্রিতে সেই কৃষ্ণাজিন গায়ে রৈভ্যকে দেখিবামাত্র পরাবসু যার পর নাই চমকিয়া গেলেন এবং হিংস্র জন্তু মনে করিয়া, নিজের প্রাণের ভয়ে তাঁহাকে হত্যা করিয়া ফেলিলেন।

 এই পিতৃ হত্যার পাপ হইতে পরাবসুকে মুক্ত করিবার জন্য, ব্রহ্মহিংসন নামক ব্রত করা আবশ্যক হইল। রাজার যজ্ঞ ছাড়িয়া পরাবসুর এই ব্রত করিতে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না, তাই অর্বাবসু তাঁহার হইয়া ব্রত করিতে গেলেন। ব্রত শেষ করিয়া তিনি যখন আবার রাজার যজ্ঞস্থানে ফিরিয়া আসিলেন, তখন সকলে বলিল, “এই ব্যক্তি ব্রহ্মহত্যা করিয়াছে! ইহাকে প্রবেশ করিতে দিও না।” ইহাতে অর্বাবসু নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া বারবার উচ্চৈঃস্বরে সকলকে বলিলেন, “আমি ব্রহ্মহত্যা করি নাই। আমার ভ্রাতা এ কাজ করিয়াছেন, আমি কেবল তাহাকে সেই পাপ হইতে মুক্ত করিয়াছি।” কিন্তু তাঁহার কথা কে শুনে? রাজার হুকুমে বিকটাকার ভৃত্যগণ আসিয়া, তাঁহাকে সেখান হইতে বাহির করিয়া দিল।

 এই অপমান এবং অবিচারের পর অর্বাবসু আর গৃহে ফিরিলেন না। তিনি মনের দুঃখে বনে গিয়া ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। সেই তপস্যায় তুষ্ট হইয়া দেবতাগণ তাঁহাকে বর দিতে আসিলেন, তিনি করজোড়ে, তাঁহাদিগকে বলিলেন, “হে দেবতাগণ, আপনাদের যদি দয়া হইয়া থাকে, তবে আমাকে এই বর দিন যে, আমার পিতা আবার জীবিত হউন, আমার ভ্রাতার পাপ দূর হউক, পিতৃদেব তাঁহার অকারণ হত্যার কথা ভুলিয়া যাউন, আর ভরদ্বাজ ও যবক্রীত দুজনেই আবার বাঁচিয়া উঠুন।”

 এ কথায় দেবগণ আনন্দের সহিত “তথাস্তু” বলিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। তারপর যে খুব আনন্দের ব্যাপার হইল, তাহা আর আমি পরিশ্রম করিয়া না বলিলেও হয়ত চলিবে।

 মরা মানুষ বাঁচিয়া উঠিলে খুব আনন্দ প্রকাশ করাই তাহার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু যবক্রীত তাহা করিবার পূর্বে দেবতাদিগকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে দেবতাগণ। আমি ত অনেক ব্রত করিয়াছিলাম, অনেক বিদ্যা শিখিয়াছিলাম তবে কেন রৈভ্যের হাতে আমার এমন দুর্দশা হইল?”

 দেবতারা বলিলেন, “বাপু! তুমি বিদ্যালাভ করিয়াছিলে ফাঁকি দিয়া, আর রৈভ্য তাহা পাইয়াছিলেন অনেক যত্নে, অনেক কষ্টে, কুরুকে সন্তুষ্ট করিয়া। এরূপ দুজনের মধ্যে যে প্রভেদ আছে তাই হয়ত তুমিও বুঝিতে পার। সুতরাং রৈভ্যের নিকট তোমার পরাভব হওয়া কিছুমাত্র আশ্চর্যের বিষয় নহে।”

 বোধহয়, এ কথায় যবক্রীতের বিলক্ষণ শিক্ষা হইয়াছিল। কেননা, তিনি যে শেষে একজন অতিশয় ধার্মিক ঋষি হইয়াছিলেন তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। লোকে সকল পাপ হইতে মুক্ত হইবার জন্য যবক্রীতের আশ্রমে আসিয়া বাস করিত।