পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৪৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 হাঁসের ভার কাঁধে করিয়া, ডাকাতের বেশে পথ দিয়া চলিয়াছে। তাহাতে তিনি নিতান্ত আশ্চর্য এবং দুঃখিত হইয়া বলিলেন, “ভাই, তুমি ব্রাহ্মণ ছিলে, আর তোমার এই দুর্দশা। তুমি কোন কুলে জন্মিয়াছ তাহা কি তোমার মনে নাই। শীঘ্র এ স্থান পরিত্যাগ কর।”

 এ কথায় গৌতমের যার পর নাই অনুতাপ হওয়াতে, সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “ভাই, আমি অতিশয় মুখ আর দরিদ্র ছিলাম, তাই লোভে পড়িয়া আমার এমন দশা হইয়াছে। আমার ভাগ্যের জোরে যদি তুমি আসিয়াছ তবে দয়া করিয়া একটি রাত আমার বাড়িতে থাক। কাল সকালে আমরা দুজনেই এখান হইতে চলিয়া যাইব।”

 গৌতমের কথায় তপস্বী, সেই রাত্রির জন্য তাহার বাড়িতে থাকিতে সম্মত হইলেন। কিন্তু তিনি ক্ষুধায় নিতান্ত কাতর হইয়াও সেই অপবিত্র স্থানে এক বিন্দু জল পর্যন্ত খাইলেন না। রাত্রি প্রভাত হইবামাত্র তিনি সে স্থান ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।

 তাহার কিঞ্চিৎ পরে, গৌতমও বাড়ি হইতে বাহির হইয়া সমুদ্রের দিকে যাত্রা করিল, এবং সেই পথে একদল বণিককে যাইতে দেখিয়া, তাহাদের সঙ্গে জুটিয়া পড়িল।

 তারপর তাহারা খানিক দূর চলিয়া, যেই একটা পর্বতের গুহার নিকট উপস্থিত হইয়াছে, অমনি একটি প্রকাণ্ড হাতি ঘোরতর গর্জনে আসিয়া সেই বণিকদিগকে আক্রমণ করিল। গৌতম তখন প্রাণের ভয়ে, বনের ভিতর দিয়া উত্তর দিক পানে উর্ধশ্বাসে ছুটিতে লাগিল। সে এইরূপে কতদুর পর্যন্ত যে ছুটিয়া গেল, তাহা তখন তাহার ভাবিয়া দেখিবার অবসর ছিল না। কিন্তু অনেকক্ষণ ছুটির পর তাহার মনে হইল যে, সে একটি সুন্দর স্থানে উপস্থিত হইয়াছে। এমন স্থান গৌতম তাহার জীবনে আর কখনো চক্ষে দেখে নাই। সেখানকার গাছপালা যেমন আশ্চর্য, পাখির গান তেমনি মিষ্ট। এ-সকল দেখিয়া শুনিয়া, গৌতমের বড়ই আশ্চর্য বোধ হইল, কিন্তু সে তথাপি দুটিতেই লাগিল। ডালে বসিয়া আশ্চর্য পাখিগণ গান করিতেছে, তাহাদের মানুষের মত মুখ; সেই অদ্ভুত পাখির দিকে চাহিয়া দেখিবার জন্যও গৌতম একটিবার দাঁড়াইল না। বন ছাড়িয়া শেষে সে মাঠে আসিয়া পড়িল। সে মাঠে বালি সোনার। সেই আশ্চর্য বালির দিকেও সে একবার চাহিয়া দেখিল না।

 এমনি করিয়া ঊর্ধশাসে ছুটিতে ছুটতে শেষে সে এক প্রকাণ্ড বটগাছের নীচে আসিবামাত্র, এমন সুন্দর একটি গন্ধ তাহার নাকে আসিয়া প্রবেশ করিল যে, সে আর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিল না। সেই গায়ে গোড়ায় চন্দনের জল ছড়ান ছিল, আর অতি সুশীতল সুগন্ধি বায়ু সেই স্থান দিয়া ধীরে ধীরে বহিতেছিল। তখন গৌতমের মনে হইল যে, তাহার অতিশয় পরিশ্রম হইয়াছে। সুতরাং সে সেই পরিস্কার সুগন্ধি বটতলায় শুইয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল।

 গৌতম অনেকক্ষণ বিশ্রাম করিল। তখন বেলা অল্পই ছিল; ক্রমে সন্ধ্যা হইল। তখন গৌতম দেখিল যে, একটি অতি সুন্দর বক পক্ষী সেই গাছে আসিয়া বসিয়াছে। সেই বকের নাম নাড়ীজঙ্ঘ; সে কশ্যপের পুত্র, ব্রহ্মার বন্ধু। তাহার আর একটি নাম রাজধর্ম।

 গৌতম সেই পক্ষীর দেবতার ন্যায় অপরূপ উজল দেহ আর আশ্চর্য অলঙ্কারসকল দেখিয়া কিছুকাল অবাক হইয়া রহিল। কিন্তু সে সময়ে তাহার যার পর নাই ক্ষুধা হওয়াতে, সে তখনই আবার তাহাকে ধরিয়া খাইবার উপায় চিন্তা করিতে লাগিল। এমন সময় পক্ষীটি তাহাকে বলিল “মহাশয়! আমার বড়ই সৌভাগ্য যে, আপনি আমার বাড়িতে অতিথি হইয়াছেন। এখন সন্ধ্যা হইয়াছে সুতরাং আজ আমার এখানেই আহার এবং বিশ্রাম করুন।