পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পুরাণের গল্প
৬৭৫

করিয়াছিলেন তেমনি আশ্চর্য। চারিদিকে আগুন জ্বালিয়া, তাহার মাঝখানে বসিয়া তিনি হাত তুলিয়া তপস্যা করিয়াছিলেন। হাজার বৎসরের মধ্যে আর সে হত নামান নাই, এই সময়ের মধ্যে মাসে শুধু একটিবারের বেশি খানও নাই।

 হাজার বৎসর এমনিভাবে চলিয়া গেল। তাহার পরে ব্রহ্মা দেবতাগণকে সঙ্গে করিয়া আসিয়া বলিলেন, “ভগীরথ। আমি তোমার তপস্যায় বড়ই তুষ্ট হইয়াছ। তুমি কি চাহ?”

 ভগীরথ ভক্তিভরে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া, জোড়হাতে বলিলেন, “প্রভু! যদি তুষ্ট হইয়া থাকেন, তবে দয়া করিয়া আমাকে গঙ্গা আনিবার উপায় করিয়া দিন।”

 ব্রহ্মা বলিলেন, “আচ্ছা বাপু, আমি তাহাই করিয়া দিতেছি। এই যে আমাদের সঙ্গে এই দেবতাটি দেখিতেছ, ইনিই গঙ্গা, হিমালয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা। ইনি তোমার কাজ করিতে পৃথিবীতে যাইবেন। কিন্তু এক কথা—ইনি স্বর্গ হইতে পৃথিবীতে লাফাইয়া পড়েন, তবে পৃথিবী তো তাহার চোট সামলাইতে পারিবে না। সে ভয়ংকর চোট খালি একজনে সহিতে পারেন, তিনি হচ্ছেন শিব। সুতরাং তুমি আগে গিয়া শিবকে সেই কাজটি করিতে রাজি করাও, তবেই গঙ্গা পৃথিবীতে নামিতে পারেন।”

 তখন ভগীরথ কেবলমাত্র পায়ের বুড়া আঙ্গুলের উপর দাঁড়াইয়া এক বৎসর ধরিয়া ক্রমাগত শিবের স্তব করিলেন। সে স্তব শুনিয়া আর মহাদেব না আসিয়া থাকিতে পারিলেন না। আসিয়াই তিনি মাথা পাতিয়া দাঁড়াইলেন, এখন গঙ্গা নামিলেই হয়।

 এদিকে গঙ্গা ভাবিতেছে, ‘দাঁড়াও, এই বুড়োকে ভাসাইয়া পাতালে লইয়া যাইব।’ এ কথা যে মহাদেব টের পাইবেন, সে খেয়াল গঙ্গার ছিল না, আর সেই বুড়ার যে কতখানি ক্ষমতা তাহাও তিনি বুঝিতে পারেন নাই। তিনি ভাবিয়াছিলেন শিবকে নাকাল করিবেন, তাহার বদলে নিজেই নাকালের একশেষ। শিবকে ভাসাইয়া নেওয়া দূরে থাকুক, তাঁহার জটার ভিতরে পড়িয়া আর তিনি বাহির হইবার পথ পান না। সে জটা এখন হিমালয়ের মতো বিশাল হইয়া গিয়াছে, তাহার গলি-ঘুচির ভিতরে গঙ্গাদেবী মা-হারা খুকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।

 বৎসরের পর বৎসর যায়, গঙ্গা তবুও সেই সর্বনেশে জটার ভিতর হইতে বাহির হইতে পারেন না। ভাগ্যিস ভগীরথ তাঁহাকে দেখিতে না পাইয়া আবার প্রাণপণে তপস্যা আরম্ভ করিয়াছিলেন, নইলে আরো কতদিন গঙ্গাকে সেখানে থাকিতে হইত কে জানে। ভগীরথের তপস্যায় তুষ্ট হইয়া শিব গঙ্গাকে ছাড়িয়া দিলেন, গঙ্গাও তখন সপ্তধারা হইয়া সাতদিকে বহিয়া চলিলেন।

 তখন অবশ্য খুবই একটা তুমুল ব্যাপার হইয়াছিল; আর সকলে ছুটিয়া তাহা দেখিতে আসিয়াছিল। এত জল, এত ফেনার এমন নৃত্য আর কখনো দেখা যায় নাই, এমন ডাকও কেহ কখনো শুনে নাই। মাছ, কুমির, কচ্ছপ, শুশুক আর সাপে পৃথিবী ছাইয়া গিয়াছিল।

 গঙ্গা সাতটি ধারায় বহিয়া সাতদিকে ছুটিলেন;তাহার একটি ধারা ভগীরথের রথের পিছু পিছু যাইতে লাগিল। যত দেবতা, যত দানব, যত মুনি-ঋষি যক্ষ রাক্ষস গন্ধর্ব পিশাচ কিন্নর সকলেই সেই রথের পিছু পিছু গঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়া চলিল।

 সেই পথের ধারে ছিল জহ্নু মুনির আশ্রম। মুনি যজ্ঞ করিতে বসিয়াছেন এমন সময় গঙ্গার জল সো ঁসো ঁশব্দে আসিয়া তাঁহার সকল আয়োজন ভাসাইয়া নিল। মুনি তাহাতে