পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৮২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 দধীচি সবে এই কাজটি করিয়া একটু নিশ্চিন্ত হইয়াছেন, আর ঠিক সেই সময়ে দেবতাদের অস্ত্রগুলির কথা মনে পড়িয়াছে। এতদিন বাদে, এত কাণ্ডকারখানার পরে, তাঁহারা আসিয়া দধীচিকে বলিলেন, “ঠাকুর, অসুরেরা তো আবার ভারি মুশকিল বাধাইয়াছে। শীঘ্র আমাদের অস্ত্রগুলি দিন।”

 দধীচি বলিলেন, “তাই তো আপনারা এতদিন আসেন নাই, তাই আমি দৈত্যদের ভয়ে সেগুলি খাইয়া ফেলিয়াছি। এখন কি করি বলুন?”

 তাহা শুনিয়া দেবতারা বলিলেন, “আমরা আর কি বলিব? আমরা বলি আমাদের অস্ত্রগুলি দিন। অস্ত্র না পাইলে আর আমাদের বিপদের সীমাই থাকিবে না!”

 দধীচি বলিলেন, “সে সকল অস্ত্র তো এখন আমার হাড়ের সহিত মিশিয়া গিয়াছে। আপনারা না হয় সেই হাড়গুলি নিন।”

 দেবতারা বলিলেন, “আমাদের অস্ত্রেরই দরকার, আপনার হাড় লইয়া আমরা কি করিব?”

 দধীচি বলিলেন, “আমার হাড় দিয়া অতি উত্তম অস্ত্র প্রস্তুত হইবে আমি এখনই দেহত্যাগ করিতেছি।”

 কাজেই তখন দেবতারা আর কি করেন? তাঁহারা বলিলেন, “আচ্ছা তবে একটু শীঘ্র শীঘ্র তাহই করুন।”

 দেবী প্রাথিতেয়ী তখন ঘরে ছিলেন না, স্নান করিতে গিয়াছিলেন দেবতারা সেই বুদ্ধিমতী, তেজস্বিনী মেয়েকে বড়ই ভয় করিতেন, তাই তাঁহারা ভাবিলেন যে, তিনি ফিরিয়া আসিবার পূর্বেই কাজ শেষ করিতে হইবে। দধীচি যোগাসনে বসিয়া একমনে ভগবানের চিন্তা করিতে লাগিলেন; দেখিতে দেখিতে তাঁহার পবিত্র আত্মা দেহ ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

 তখন দেবতারা বিশ্বকর্মাকে বলিলেন, “এখন তুমি ইহার হাড় দিয়া অস্ত্রশস্ত্র তয়ের কর।”

 বিশ্বকর্মা বলিলেন, “আমি কি করিয়া অস্ত্র তয়ের করিব? ইহার দেহ কাটিলে তবে তো হাড় পাওয়া যাইবে। বাপ রে! সে কাজ আমা দ্বারা হইবে না! হাড়গুলি পাইলে আমি এখনই তাহা দিয়া অস্ত্র গড়িয়া দিতে পারি।”

 তখন দেবতাদের কথায় গোরুর দল আসিয়া গুঁতাইয়া মুনির দেহ হইতে হাড় বাহির করিয়া দিল, দেবতারাও মহানন্দে তাহা লইয়া প্রস্থান করিলেন। সেই হাড় দিয়া শেষে বিশ্বকর্মা বজ্র প্রভৃতি নানারূপ আশ্চর্য অস্ত্র প্রস্তুত করিয়াছিলেন।

 এদিকে প্রাতিথেয়ী স্নান আহ্নিকের পর কলসী হতে আশ্রমে ফিরিয়া দেখেন, মহর্ষি নাই, তাঁহার মাংস, লোম আর চামড়া মাত্র পড়িয়া আছে। ঘরে অগ্নি ছিলেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেবী সকল কথাই জানিতে পারিলেন। সেই দারুণ সংবাদ বজ্রাঘাতের ন্যায় তাঁহার চেতনা হরণ করিয়া লইল; তাঁহার দেহ ধূলায় লুটাইয়া পড়িল। জ্ঞান হইলে পর অনেক কষ্টে শোক সম্বরণপূর্বক তিনি দধীচির দেহের অবশিষ্টটুকু লইয়া আগুনে ঝাঁপ দিলেন। যাইবার সময়ে নিজের নিতান্ত শিশুপুত্রটিকে গঙ্গার নিকটে আর গাছপালার নিকটে সঁপিয়া দিয়া বলিয়া গেলেন, “এই পিতৃমাতৃহীন শিশুটিকে তোমরা দয়া করিয়া দেখিবে।”

 দধীচিও গেলেন প্রতিথেয়ীও গেলেন। আশ্রম অন্ধকার হইল। তপোবনের পশুপক্ষী আর বৃক্ষলতারা তখন কাঁদিয়া বলিল, “হায়! যাঁহারা আমাদের পিতা মাতার মতো ছিলেন,