পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৭০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পুরাণের গল্প
৭০৫

জ্ঞাতিবন্ধুগণের সহিত মিলিয়া সৃষ্টি তোলপাড় করিয়া তুলিল। ইন্দ্র, বরুণ, কুবের কাহাকেও সে নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে দিল না, সকলেরই ধনসম্পত্তি কাড়িয়া লইল। তখন দেবতাগণ তাহার জ্বালায় অস্থির হইয়া বিষ্ণুর নিকট নিজ নিজ দুঃখ জানাইলে বিষ্ণু বলিলেন, “তোমাদের কোনো ভয় নাই, আমি শীঘ্রই এই দৈত্যকে বধ করিয়া তোমাদের দুঃখ দূর করিব।”

 কিন্তু বিষ্ণুর উপরেই হিরণ্যকশিপুর সর্বাপেক্ষা অধিক রাগ ছিল। সে তাঁহার পূজা বন্ধ করিয়া দিবার জন্য কোনো চেষ্টারই ত্রুটি করে নাই। তাহার নিজের পুত্র প্রহ্লাদ বিষ্ণুভক্ত ছিল, সেজন্য দুষ্ট দৈত্য সেই বালককে কি ভীষণ যন্ত্রণাই দিয়াছিল। কিন্তু প্রহ্লাদ কিছুতেই হরিনাম পরিত্যাগ করে নাই। হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোর হরি কোথায় আছে?” প্রহ্লাদ বলিল, “তিনি সর্বত্রই আছেন।” হিরণ্যকশিপু একটা থাম দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এই থামের ভিতর আছে?” প্রহ্লাদ বলিল, “অবশ্য আছেন।” হিরণ্যকশিপু তখন খড়গ লইয়া মহারোষে সেই স্তম্ভে আঘাত করিল। আমনি বজ্রপাতের ন্যায় ভীষণ গর্জনে বিষ্ণু সেই স্তম্ভের ভিতর হইতে বাহির হইলেন, তাঁহার দেহ অর্ধেক মানুষের, অর্ধেক সিংহের ন্যায়; নখ অতি ভীষণ; কেশর উড়িয়া মেঘে ঠেকিয়াছে মুখ দিয়া আগুন বাহির হইতেছে। দৈত্যেরা ক্ষণমাত্র তাঁহার সহিত ভীষণ যুদ্ধ করিল। কিন্তু সেই ভয়ংকর নৃসিংহ মূর্তি নিজের নিঃশ্বাস দ্বারাই আর সকল দৈত্যকে মুহূর্তে ভস্ম করিয়া, দেখিতে দেখিতে হিরণ্যকশিপুর বুক নখে চিরিয়া তাহার রক্ত খাইতে আরম্ভ করিলেন।

 এত করিয়াও সেই ভীষণ মূর্তির রাগ দূর হইল না, তাঁহার মুখের আগুনও নিভিল না। তখন দেবতাগণ যারপরনাই ভয় পাইয়া তাঁহাকে থামাইবার উপায় দেখিতে লাগিলেন কিন্তু কাহারও তাঁহার নিকটে যাইতে ভরসা হইল না। ইন্দ্র বলিলেন, “আমার চোখ ঝলসিয়া যাইবে।” ব্রহ্মা বলিলেন, “আমার দাড়ি পুড়িয়া যাইবে।”

 গণেশ অনেক সাহস করিয়া তাঁহার ইঁদুরে চড়িয়া কিছুদূর আসিয়াছিলেন, কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ নৃসিংহের ফুঁ লাগিয়া তাঁহার ইঁদুরটি উলটিয়া যাওয়াতে তাঁহাকে তাঁহার সেই বিশাল ভুঁড়িসুদ্ধ গড়াগড়ি যাইতে হইল।

 শেষে আর কোনো উপায় না দেখিতে পাইয়া দেবতাগণ মহাদেবের শরণাপন্ন হইলে, মহাদেব অতি অদ্ভুত শরভের মূর্তি ধরিয়া নৃসিংহের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই শরভকে দেখিবামাত্র নৃসিংহের রাগ থামিয়া গেল, সকলের ভয়ও দূর হইল।

 দেবতাদিগের সহিত অসুরেরা চিরকালই ঘোরতর শত্রুতা করিত, আর অনেক সময়ই তাহাদের লাঞ্ছনা করিত যতদূর হইতে হয়। প্রহ্লাদের পিতা কি করিয়াছিল, তাহা আমরা পূর্বেই শুনিয়াছি। প্রহ্লাদের নাতি ‘বলি’ও তাহার চেয়ে নিতান্ত কম করে নাই। এদিকে বলি ধার্মিক ছিল খুবই, কিন্তু তাহা হইলে কি হয়? সে যে অসুর, কাজেই দেবতাদের সঙ্গে শত্রুতা না করিয়া থাকিতে পারিত না।

 একবার সে ইন্দ্রের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে দলবলসুদ্ধ স্বর্গ হইতে তাড়াইয়া দিল। তখন দেবতাগণ আর কি করিবেন? তাঁহারা অতিশয় দুঃখিত হইয়া বিষ্ণুর আশ্রয় লইলেন। এদিকে ইন্দ্রের মাতা অদিতিদেবীও একমনে বিষ্ণুকে ডাকিয়া এই প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “হে দেব। আমাকে এমন একটি পুত্র দান কর, যে এই সকল অসুরকে বধ করিতে পারে।” কিছুকাল এইরূপে প্রার্থনা করার পর বিষ্ণু তাঁহাকে দেখা দিয়া বলিলেন, “মা, তুমি দুঃখ

উপেন্দ্র-৮৯