পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯২০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 ভারতবর্ষে যখন প্লেগের আক্রমণ আরম্ভ হইল, তখন ভিয়েনার বৈজ্ঞানিক চতুষ্পাঠি হইতে একদল কৃতবিদ্য লোককে এই ব্যাধির সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিবার জন্য বোম্বাই পাঠান হয়। ডাক্তার মূলার এই দলের নেতা হইয়া তখন এদেশে আসেন। বোম্বাই শহরে ইঁহারা তিন মাস ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ডাক্তার মূলার এক হাজারেরও বেশি রোগীকে পরীক্ষা করিয়াছিলেন। যেখানে প্লেগ সকলের চাইতে বেশি, সেইসকল জায়গা খুঁজিয়া বাহির করিয়া রোগীদিগকে দেখিতেন এবং তাহদের বেয়ারামের অবস্থা লিখিয়া রাখিতেন। এইরূপে তিন মাস প্লেগের সম্বন্ধে নানারূপ সংবাদ সংগ্রহ করিয়া ইঁহারা দেশে ফিরিলেন।

 যাইবার সময়ে ইঁহারা প্লেগের বীজ সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন। সেই বীজ নানারূপ ইতর জন্তুর শরীরে পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য বৈজ্ঞানিক চতুষ্পাঠি ডাক্তার মূলারের উপর ভার দিলেন। সেখানকার একটা বড় হাসপাতালের এক অংশে এই কার্যের জন্য স্থান নির্দেশ করা হইল। প্লেগের বীজের ন্যায় মারাত্মক জিনিস লইয়া কাজ করিতে হইলে যত রকম সতর্কতার প্রয়োজন হয়, তাহার সমস্তই অবলম্বিত হইয়াছিল।

 এই কার্যের জন্য যে ঘর নির্দিষ্ট ছিল তাহা ও ব্যবহৃত যন্ত্রাদি পরিষ্কার রাখা, এবং যে সকল জন্তুর শরীরে পরীক্ষা হইতেছিল তাহদের যত্ন করা, তাহদের খাঁচা পরিষ্কার করা, কোনটা মরিয়া গেলে তাহাকে পোড়াইয়া ফেলা—এইসকল কাজের জন্য বারিশ নামক এই ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হইল। এই কার্যে কিছুমাত্র অসতর্ক হইলে কিরূপ বিপদের আশঙ্কা তাহা বারিশকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া হইয়াছিল;বারিশও এক বৎসর পর্যন্ত সকলপ্রকার নিয়ম যথাসাধ্য পালন করিয়াছিল। এই এক বৎসরের মধ্যে কোনরূপ দুর্ঘটনা হয় নাই। কিন্তু ক্রমে সাহস বাড়িয়া যাওয়াতে বেচারা শেষে অসতর্ক হইয়া পড়িল। সে জানিত না, যে এইরূপ অসতর্কতার দরুন তাহার প্রাণ যাইবে।

 বার বার নিয়মভঙ্গ করাতে বারিশের প্লেগ হইল। ডাক্তার মূলার দিন রাত হাজির থাকিয়া তাহার চিকিৎসা করিতে লাগিলেন। নিজের রোগীদিগকে অন্যের হাতে দিয়া এবং ছাত্রদিগকে পড়াইবার জন্য অন্যরূপ বন্দোবস্ত করিয়া, এমনকি একরকম নিজের খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করিয়া, তিনি বারিশের জন্য খাটিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহাকে বাচাইতে পারিলেন না। চারিদিনের অসুখে বারিশ মারা গেল।

 বারিশের মৃতদেহ ছুঁইয়া পাছে অন্যের প্লেগ হয়, সেই ভয়ে তাহাকে কফিনে পুরিবার কাজটা মূলার আগাগোড়া নিজ হাতেই করিলেন। তারপর সেই ঘর ধুইয়া ফেলা, ঘরের জিনিসপত্র মাজা ঘসা ইত্যাদি সকল কাজ একাই শেষ করিলেন—পাছে অন্যকে করিতে দিলে তাহারও প্লেগ হয়। ডাক্তার মূলার ব্যতীত আর দুটি লোক (দুইজন শুশ্রুষাকারিণী) বারিশের শুশ্রুষা করিয়াছিল। বারিশের মৃত্যুর দুইদিন পরে ইহাদের একজনের প্লেগ হইল। বারিশের চিকিৎসা করিয়া ডাক্তার মূলার খুব ক্লাস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন, তথাপি তিনি বারিশকে যেমন যত্ন করিয়া চিকিৎসা করিয়াছিলেন,ইহাকেও তেমনি যত্ন করিয়া চিকিৎসা করিতে লাগিলেন। রোগ পরীক্ষা করা, ঔষধ দেওয়া, উপদেশ আর মিষ্ট কথা দ্বারা সান্ত্বনা করা ইত্যাদিতে রাত্রির অধিকাংশ চলিয়া গেল; শেষ রাত্রিতে তাঁহার অতিশয় কাঁপনি ধরিল। তখন শীতকাল ছিল, সুতরাং প্রথমতঃ সেই কাঁপনিকে তিনি তত গ্রাহ্য করিলেন না। ঘরে ঢুকিবার সময় তাঁহার শরীর ভয়ানক দুর্বলবোধ হইতে লাগিল;তখন তাঁহার মনে একটু সন্দেহ হইল, বুঝিবা তাঁহারও প্লেগ