পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৫০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

কলকাতার থানা এবং ডাক্তারখানা একটিও বাকি রহিল না, নারিকেলডাঙ্গা প্রভৃতি স্থানেও অনুসন্ধানের ত্রুটি হইল না, কিন্তু তাহার কোনো সন্ধানই পাওয়া গেল না। বাড়ির মেয়েরা ইহার অনেক পূর্ব হইতেই কাঁদিতে আরম্ভ করিয়াছেন। এই-সকল অনুসন্ধানে রাত্রি আটটা বাজিয়া গেল। এমন সময় আমাদের মনে হইল যে, হয়তো সে আড়কাঠিদের হাতে পড়িয়াছে। এই চিন্তায় আমাদের মনের কিরূপ অবস্থা হইল সহজেই বুঝিতে পার।

 আমাদের একজন বন্ধু, (তাঁহাকে বিদ্যারত্ব মহাশয় বলিব), আড়কাঠিদের সম্বন্ধে অনেক খবর রাখেন। ইনিই প্রথমে কুলিদের অবস্থার প্রতি দেশের লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিদ্যারত্ব মহাশয় যেই খবর শুনিলেন, অমনি তিনি লাঠি হাতে করিয়া অনুসন্ধানে বহির হইলেন। এ বিষয়ে কলিকাতার যত সন্দিগ্ধ স্থান আছে, তিনি তাহার প্রায় সকলগুলির কথাই জানেন, কিন্তু যত জায়গায় গেলেন, কোথাও কোনরূপ সন্ধান পাইলেন না। শেষে যেখানে গিয়েছিলেন সেখানে কতগুলি ষণ্ডা লাঠি লইয়া তাঁহাকে তাড়া করিয়াছিল। তিনি অনেক পুণ্যের জোরে সেই ভয়ানক সংকীর্ণ গলির ভিতর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া বড় রাস্তায় আসিয়া বাঁচিলেন।

 বারোটাব সময় বিদ্যারত্ব মহাশয় ক্ষুন্ন মনে ঘরে ফিরিলেন। স্টেশনে স্টেশনে লোক গিযছিল তাহারা ইহার অনেক পূর্বেই ফিরিয়াছে। সকলেই স্তব্ধ, কাহারো মুখে কথাটি নাই। যেরূপে বাত্রি কাটিল, তাহার কিঞ্চিৎ কেহ কেহ বুঝিতে পারবেন, আমার বলিবার সাধ্য নাই।

 ভোরে উঠিয়া আবার সকলে অনুসন্ধানে বাহির হইলেন। কেবলমাত্র দাদা বাড়িতে রহিলেন। সাতটার সময় একজন লোক আসিয়া দরজায় ঘা দিল। প্রশ্নের পর সে বলিল, ‘আমি মযরা, মহাশয়ের বাডিতে একটি ছেলের নিকট জলখাবার দরুন টাকা পাইব। কাল সকালে বিশেষ করিয়া তাগাদা করাতে বলিয়াছিল আমার সঙ্গে এস। আমরা লোক সঙ্গে দিলাম, তাহাকে এই বাড়ির দরজায় দাঁড় করাইয়া ভিতরে গেল। কিছুকাল পরে বাহিবে আসিয়া বলিল, এখানে নয়, ও বাড়ি (লেখকের বাড়ি) চল।’ ও বাড়িতে কিছুকাল থাকিয়া আমায় বলিল—‘বিকালে’। তাই আমি আসিয়াছি, টাকাটা এখন পাইব কি? এত ছোটছেলেকে ওরকম করিয়া ধারে সন্দেশ কেন খাওয়াইলে জিজ্ঞাসা করাতে ময়রা তাহার কোনো ভালো উত্তর দিতে পারিল না। অপ্রতিভ হইয়া সম্প্রতি সরিয়া পরিল।

 আমার ভাগ্‌নের সম্বন্ধে প্রকৃত কথা এখন একটু একটু বুঝিতে পারা গেল। তাহার জ্যাঠামহাশয়ের বাড়িতে তৎক্ষণাৎ পুনরায় লোক পাঠানো হইল। সেখানে গিয়া দেখা গেল যে, সে ঠোঙ্গায় করিয়া জলখাবার খাইতেছে। দূর হইতে কে আসিতেছে দেখিয়াই ঠোঙ্গাটি রাখিয়া বসিয়া রহিল। অনেক প্রশ্নের পর তাহার ইতিহাস বলিল আর বলিল যে, ‘তোমরাই কি শুধু পরিশ্রম করিয়াছ? আমিও ঢের ঘুরিয়াছি।’

 আমাদের ওখান হইতে বাহির হইয়া সে কালীঘাট গিয়াছিল। তাহার সঙ্গে একটিও পয়সা ছিল না, সুতরাং এই রাস্তাটুকু হাঁটিয়াই যাইতে হইয়াছিল। ময়রার ভীষণ মূর্তি তাহার প্রাণে জাগিতেছিল। তারপর ময়রা যদি মাতুল মহাশয়কে বলে, তবে নিতান্তই লজ্জার বিষয় হইবে এবং শাস্তিরও বিশেষ সম্ভাবনা বোধ করিল। কাজেই তাহার কাছে আসিতে কিছুতেই ভরসা হইতেছিল না। কালীঘাটে পরিচিত স্থান নাই, সুতরাং শীঘ্রই সেখান হইতে ফিরিতে হইল। এরপর হাইকোর্টের দিকে চলিল। গড়ের মাঠের মাঝামাঝি আসিয়া বড়ই ক্লান্তি বোধ করিতে