পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

আজই ভরতকে আনিতে দূত পঠাইয়া দিন। আমিও আজই বনে চলিয়া যাইতেছি। কিন্তু বাবা কেন, নিজে আমাকে এ কথা বলিলেন না?’

 কৈকেয়ী বলিলেন, “বেশ বেশ, ভরতকে আনিতে আজই ঘোড়ায় চড়িয়া লোক যাইবে। আর তুমিও দেখিতেছি বনে যাইবার জন্য বড়ই ব্যস্ত হইয়াছ। শীঘ্র যাও, শীঘ্র যাও! মহারাজের বড় লজ্জা হইয়াছে, তাই কথা বলিতেছেন না। কিন্তু তুমি যতক্ষণ চলিয়া না যাইতেছ, ততক্ষণ তাহার স্নানাহার নাই।’

 এই কথা শুনিয়া দশরথ ‘হায় হায়’ করিতে করিতে আবার অজ্ঞান হইয়া গেলেন। বনে যাইবার কথায় রামের কোন কষ্টই হয় নাই, কিন্তু পিতার দুঃখে তিনি অস্থির হইলেন ‘হায়, পিতার একটু সেবাও করিতে পারিলাম না, কারণ এখনই বনে যাইতে হইবে!’ কাজেই কোন রকমে রাজাকে একটু তুলিয়া বসাইয়া তাহাকে সেখান হইতে চলিয়া আসিতে হইল।

 কৈকেয়ীর ব্যবহারে লক্ষ্মণ রাগে অস্থির হইয়া উঠিলেন, কিন্তু রামের কিছুমাত্র দুঃখের ভাব দেখা গেল না। তিনি লক্ষ্মণকে সঙ্গে করিয়া ধীরে ধীরে কৌশল্যার বাড়িতে চলিলেন। সেখানে মেয়েরা সুন্দর সাজ পোশাক পরিয়া তাহারই জন্য আমোদ আহ্লাদ করিতেছিল। তাহা দেখিয়াও তাহার দুঃখ হইল না। তাহার মনে কেবল এই ভাবিয়া দুঃখ হইল যে, তিনি গেলে হয়ত তাহার পিতা মাতা মরিয়া যাইবেন।

 রামের বনবাসের কথা ততক্ষণে অনেকেই শুনিয়াছে, আর সকলেই কাঁদিয়া কাঁদিয়া রাজার নিন্দা করিতেছে। কিন্তু মা কৌশল্যা তখনও ইহার কিছুই জানিতে পারেন নাই। রাম যুবরাজ হইবেন তাহাই তিনি জানেন;আর তাঁহারই জন্য মনের সুখে দেবতার পূজা করিতেছেন। এমন সময় রাম সেখানে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। কৌশল্যা আনন্দে তাহার গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিলেন, বাবা, আজ তুমি যুবরাজ হইবে। আশীর্বাদ করি, অনেক দিন সুখে বাঁচিয়া থাক। ধর্মে তোমার মতি হউক, আর সকলে তোমাকে ভালবাসুক।’

 রাম বলিলেন, ‘মা, তোমার বড় দুঃখের সময় আসিয়াছে। তুমি তো জান না, মা, আমি এখনই দণ্ডকবনে যাইব। মহারাজ ভরতকে রাজ্য দিবেন, আমাকে তপস্বীর বেশ ধরিয়া চৌদ্দ বৎসরের জন্য বনে যাইতে হইবে।’

 আমরা অনেক সময়ে লোকের কষ্ট বুঝিতে পারি। কিন্তু হয়, আমাদের এমন কী সাধ্য আছে যে, মা কৌশল্যার প্রাণের কষ্ট বুঝিতে পারিব? তিনি অজ্ঞান হইয়া গেলেন, সকলে সেবা করিয়া তাঁহাকে সুস্থ করিল। জ্ঞান হইলে পর তিনি বলিলেন, বাছ রাম, তুমি যদি না হইতে তবে আমার এত কষ্ট হইত না। এখন তোমাকে হারাইয়া আমি কী করিয়া বাঁচিব? হায় হায়, আমার বুকটা কি লোহার, যে এত দুঃখেও ফাটিয়া গেল না? আমার কি মরণ নাই? আহা, যমের ঘরে বুঝি আমার মত দুঃখিনীর জন্য একটু জায়গা হইবে না। বাছ, তুমি যেখানে যাইবে, আমিও সেইখানে যাইব। আমাকে তোমার সঙ্গে লইয়া চল।’

 কৌশল্যার দুঃখ দেখিয়া লক্ষ্মণ কাদিতে কাদিতে বলিলেন, মা, দাদা কিসের জন্য বনে যাইবেন? মহারাজ এখন বুড়া হইয়াছেন, তাহার কি মাথার ঠিক আছে? তাহ না হইলে কেন স্ত্রীর কথায় ভুলিয়া এমন লোককে বনে পাঠাইতেছেন? এমন রাজার কথা না শুনিলে কী হয়?'

 তারপর তিনি রামকে বলিলেন, ‘দাদা, একবার হুকুম দাও তো দেখি কে তোমাকে রাজ্য