পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৮০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

আমার দাদা যেরূপ সতর্ক হইয়াছিলেন, এতটা না হইলেও চলিবে। তিনি নাকি বড়ই হুঁসিয়ার লোক, তাই কটক হইতে পুরী আসিবার পথে তিনি ভুবনেশ্বরেই তাড়াতাড়ি নামিয়া গাড়ি বদলাইতে ছুটলেন। গাড়ি যে পাইলেন না তাহা বোধ হয় আর আমার না বলিলেও চলিবে, ততক্ষণে তিনি যে ট্রেনে আসিয়াছিলেন, তাহাও ছাড়িয়া গেল! কিন্তু —’ দাদা সহজে দমিবার লোক নহেন। তিনি বলিলেন, “ভালোই হইল ভুবনেশ্বর দেখিয়া যাই!”

 পুরী পৌছাইবার চারি-পাঁচ মাইল থাকিতেই জগন্নাথের মন্দির দেখিতে পাওয়া যায়। যেন একটা প্রকাণ্ড ভুট্টা। ভুট্টার দানা যেরূপ করিয়া সাজানো থাকে, মন্দিরের আকৃতিও কতকটা ভুট্টারই মতন। মন্দিরের এই দৃশ্যটি দেখিতে বেশ সুন্দর, কিন্তু কাছে গিয়া আমার তাহা এত সুন্দর বোধ হয় নাই বিশাল সবুজ মাঠের মাঝখানে বিস্তৃত জলাশয়, তাহার পাশে সেই প্রকাণ্ড মন্দির, গাছপালা তাহার কোমরের নীচে পড়িয়া আছে। দেখিলে বাস্তবিকই তাহাকে একটা যেমন তেমন জিনিস বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু মনের এই আনন্দটুকু অল্পক্ষণই থাকে যতই কাছে যাওয়া যায়, ততই ছোট-ছোট জিনিসে মন্দিরকে আড়াল করিয়া ফেলে। সে সবুজ মাঠ আর বিশাল জলাশয়ের নির্মল জল দেখা যায় না। সমুদ্রের বালি, আর হাডিডসার গাছপালা তাহার স্থান অধিকার করে। ইহার উপর আবার যেই স্টেশনে নামিলাম আমনি,

‘—দক্ষিণে, বামে, পিছনে সম্মুখে যত
লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত।’

 আমি তীর্থ করিতে পুরী যাই নাই, বেয়ারাম সারাইবার জনা গিয়াছিলাম। কিন্তু বার বার সবিনয়ে বলাতেও পাণ্ডা মহাশয়েরা আমার কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করিতে চাহিলেন না। আমি যত বেশি করিয়া বলি, তাহারাও ততই আরো যত্বপূর্বক আমাকে আহ্বান করেন। শেষটা গাড়িতে উঠিয়া কতকটা নিশ্চিন্ত হইলাম বটে, কিন্তু বাসায় আসিয়া দেখি, সেখানে একজন আসিয়া আছেন!

 যাহা হউক, শেষটা ইহাকেও বুঝিতে হইল যে এ ব্যক্তিকে ছাড়িয়া দেওয়াই ভালো। আমিও রক্ষা পাইয়া নিজের অবস্থা এবং বাসস্থান বিষয়ে মনোযোগী হইলাম।

 এইখানে একটা কথা বলিয়া রাখি। আমি বেয়ারাম লইয়া সেখানে গিয়াছিলাম। নিয়ম পালন করিতেই আমার সমস্ত সময় কাটিয়া যাইত চারিদিকে বেড়াইয়া দেখিবার অবসর আমার হয় নাই। বেড়াইবার অবসর যখন হইত, তখন সমুদ্রের ধারে চলিয়া যাইতাম। মন্দিরের ওদিকে দু-একদিন মাত্র গিয়াছিলাম। আমার ভিতরে যাইবার উপায় ছিল না বাহির হইতে যাহা দেখা যায়, তাহাই দেখিয়াছি। সুতরাং মন্দিরের সম্বন্ধে আমার বেশি কথা বলিবার নাই।

 মন্দিরটা খুব বড়। আর প্রাচীর সিংহদ্বার প্রভৃতি লইয়া দেখিতেও বেশ জমকাল। কিন্তু কাছে গিয়া কারুকার্য তেমন ভালো বোধ হয় না। সামনের রাস্তাটি খুবই চওড়া,আমি আর কোথাও এমন প্রশস্ত পথ দেখি নাই। এই পথে জগন্নাথের রথ চলে। পথের এক প্রান্তে রথখানি রহিয়াছে। সেখানকার বড় পর্ব রথযাত্রা। রথযাত্রার সময় দুই তিন লক্ষ লোক পুরীতে জড়ো হয়। এই কয়দিন ইহারা জগন্নাথের প্রসাদ খাইয়াই দিন কাটায়। প্রসাদ বাজারে বিক্রয় হয়, কিনিয়া খাইলেই হইল। যাহা খাইতে পারে খাইবে অবশিষ্ট আর একবার খাইবার