পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৮৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

যে সে যথেষ্ট মনে করিবে তাহা নহে, সমুদ্রকে একবার না দেখিয়া, তাহাকে পূজা না করিয়া, তাহাকে কিছুফল না খাওয়াইয়া আর তাহার ঢেউ না খাইয়া দেশে ফিরিলে তাহার সকলই অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়।

 নিতান্ত গরিব, আর নিতান্ত পাড়াগেয়ে লোক, পূজা করিবার পয়সা নাই, ঢেউ খাইবার ভরসা নাই, এমন লোকও সমুদ্রকে একবার সেলাম না করিয়া দেশে ফিরিবে না। আমি প্রায়ই দুপুরবেলা সমুদ্রের ধারে গিয়া বসিয়া থাকিতাম, তখন এইসকল লোককে দেখিতে আমার বড়ই ভালো লাগিত। উহাদের অনেকেই দূর দেশ হইতে আসিয়াছে হয়তো খোকাখুকি, অথবা ছোট ভাই বোন, না হয় আর কেহ। উহাদের জন্য দু-একটি সুন্দর উপহার প্রায় সকলেই কিনিয়াছে। রঙ্গিন বাঁশের ছাতা, সরু সরু বেত,বিচিত্র বর্ণের থলে এইরূপ দু-একটি জিনিস প্রায় প্রত্যেকেরই হাতে। পুঁটুলির ভিতর হয়তো আরো কত জিনিস আছে। কেহ কেহ আবার দুটি করিয়া ছাতা কিনিয়াছে। বাঁশের ছাতা গুটাইবার জো নাই;কাজেই দুটিকেই মাথায় দিয়া চলিতে হইতেছে। তাহাতে চেহারাখনি খুলিয়াছে ভালো। মাঝে মাঝে আবার এক একজনের মাথায় এক একটা কড়া। তাহাতে ছাতার কাজও চলিতেছে, টুপির কাজও হইতেছে, আবার দরকার হইলে রান্নার কাজও চলিবে।

 ইহারা যে কতখানি কৌতুহল আর আগ্রহের সহিত সমুদ্র দেখিতে আসিয়াছে, তাহা ইহাদের মুখ দেখিলেই বোঝা যায়। আর সমুদ্রকে দেখিয়া যে তাহারা কিরূপ সন্তুষ্ট হইয়াছে তাহাও উহাদের সম্ভাষণেই প্রকাশ! হা রে! সমুদ্রের মহারাজ। ইহারা সাধারণত দূর হইতে সমুদ্রের প্রতি ভক্তি দেখাইয়াই চলিয়া যায়। কদাচিৎ দুই-একজন কাছে যাইতে সাহস করে। যাহারা কাছে যায়, তাহদের উদ্দেশ্য একটু সমুদ্রের জল তুলিয়া মাথায় দেওয়া। একাজটি অনভ্যস্ত লোকের পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে। যেদিন সমুদ্রে ঢেউ বেশি থাকে, সেদিন এরূপ করিতে বেশ একটু সাহসের আবশ্যক। একস্থানে দাড়াইয়া সমুদ্রের জল হাতে পাওয়া অতি অল্প সময়ই সম্ভব হয়। ঢেউয়ের সঙ্গে জল এক একবার ছুটিয়া কাছে আসে, আবার অনেকদূর হটিয়া যায়। তাহাও যে শাস্তভাবে করে, তাহা নহে। তুমুল বিক্রম আর তর্জনগর্জনের সহিত ঢেউ আসিয়া ডাঙ্গায় ভাঙ্গিয়া পড়ে;তাহা দেখিলে মনে ভয় হওয়ারই কথা। ইহার সামনে সাহস করিয়া জল লইতে যে অল্প লোকেই যায়, তাহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। আর, ইহারাও যে একটু জল ছুঁইয়া মাথায় দিতে পারলে মুহূর্তকালও সেখানে বিলম্ব করে না, এ কথা বলাই বাহুল্য।

 মানুষের দেহে যেমন মুখখানিই সকলের আগে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সমুদ্রের এই ঢেউগুলি সেইরূপ। সমুদ্রকে দেখিতে পাওয়ার অনেক আগেই ঢেউয়ের কোলাহল শুনিতে পাওয়া যায়। এ কোলাহলের আর নিবৃত্তি নাই। যেন দেশের সব রেলগাড়ি আর ঝড়েদের মধ্যে বচসা। এদিকে হয়তো হওয়ার লেশমাত্র দেখা যায় না, কিন্তু সমুদ্রে গিয়া দেখ, ঢেউয়ের নৃত্যের বিরাম নাই। লম্বা-লম্বা ঢেউ পনেরো-কুড়ি হাত চওড়া, চারি-পাঁচ হাত উঁচু, আর একশত গজ হইতে সিকি মাইল পর্যন্ত লম্বা। কোথা হইতে ক্রমাগত তীরের সঙ্গে এই খেলা ভিন্ন উহাদের আর কোনো কাজ নাই। ঢেউটা তীরের উপর আসিয়া পড়িল, আবার তীরের ধাক্কা খাইরা ফিরিয়া চলিল। ততক্ষণে পিছন হইতে আর এক ঢেউ আসিয়া উপস্থিত, কাজেই দুটিতে ঠোকাঠুকি হইয়া গেল। তখনকার দৃশ্য দেখিতে অতিশয় অদ্ভূত। বাজপড়ার