পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবিধ প্রবন্ধ
৯৯৭

যেন পুরানো জুতার পচা চামড়া আর হাড়ের কুচি দিয়া তাহাকে গড়িয়াছে। কিন্তু আমি পুস্তকে পড়িয়াছি যে অতিশয় সুন্দর তারা মাছ আছে। আর তাহাদের কোনো কোনোটার এই একটা আশ্চর্য স্বভাব আছে, যে তাহারা ভয় পাইলে আত্মহত্যা করে। সমুদ্রের ভিতরে অনেক নাড়াচাড়া সহ্য করে; কিন্তু জল হইতে তুলিলেই সে দেখিতে দেখিতে তাহার হাত পা ফেলিয়া দেয়। তারা মাছের মাঝখানটায় তাহার মুখ থাকে; চারিধারের পাপড়ি অথবা ডালপালার মতন জিনিসগুলি তাহার হাত পা। কোনো কোনোটা সাঁতরাইতে পারে, শিকার আঁকড়িয়া ধরিতেও পারে। কিন্তু কোনো কোনোটার হাত পা নাড়িবার বেশি ক্ষমতা আছে বলিয়া বোধহয় না। আবার চলাফেরা করিতেই পারে না, একটা বোঁটা দ্বারা কোনো জিনিসের গায়ে আটকানো থাকে, এরূপ তারা মাছও আছে।

 জেলী মাছ সেখানে অনেকরকম আছে। আকারে আধুলি হইতে ঝুড়ির মতন পর্যন্ত জেলী মাছ দেখিয়াছি। ইহাদিগকে দেখিলে তালশাঁস অথবা থক্‌থকে সাগুর কথা মনে হয়। সকলগুলিরই সাধারণ আকৃতি ছাতা অথবা টুপির মতন, কোনো কোনোটা ওড়িয়া বেয়ারাদের পানের থলের মতন। আবার সকলেরই কোনোরকমের ঝালর আছে। রঙ সাদা অথবা লালচে, তাহাতে অনেক সময় সবুজ কারিকুরি থাকে। ইহারা জলে সাঁতরাইয়া বেড়ায়, আর ভয় পাইলে শরীর কোঁচকাইয়া হাত পা গুটাইয়া (ঐ ঝালর উহাদের হাত পা, মাঝখানে মুখ) সমুদ্রের তলায় পড়িয়া যায়। কোনো কোনোটা রাত্রিতে জ্বলে। অনেকগুলি আবার এমন আছে যে তাহা গায়ে লাগিলে ভয়ানক যন্ত্রণা হয়। এই যন্ত্রণা কতকটা বিছুটির জ্বালার মতন, কিন্তু তার চাইতে অনেক বেশি, আর ইহাতে বুকের ভিতরে কেমন একটা কষ্ট বোধহয়। জালে পড়িয়া বিস্তর জেলী মাছ উঠে; জেলেরা জেলী মাছকে বলে ‘সৎরাং’। ইহাদের ইংরাজি নাম ‘জেলী ফিশ’ আর ‘সাগর বিছুটি’ (Sea nettle)। ইহাদের কোনোটা নির্দোষ আর কোনোটা বিষাক্ত, জেলেরা তাহা বেশ বুঝিতে পারে। সাধারণত তাহারা এগুলিকে দুহাতে ঘাঁটে, রাঁধিয়া নাকি খায়ও। কিন্তু একদিন একটা খুব উজ্জ্বল স্বচ্ছ আর সবুজ কারিকুরিওয়ালা জেলী মাছ দেখিয়া যেই তাহার কাছে গিয়াছি, অমনি একজন জেলে আমাকে নিষেধ করিয়া বলিল, ‘বাবু, বিন্ধিব।’ অবশ্য আমি আর তাহার কাছে যাই নাই। আর আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, যে উহার চেহারা আমি কখনো ভুলিব না। অতঃপর আবার তাহাকে দেখিতে পাইলে আমিও বলিতে পারিব—‘বিন্ধিব'। এরপর ‘কট্‌ল্‌’ মাছের (cuttle fish) কথা বলি, তবেই শেষ হয়। এ মাছ যে, মাছ নয়, তাহা তো বলিয়াই রাখিয়াছি। ইহারা শামুক জাতীয় জন্তু; কিন্তু শামুকের মতন ইহাদের খোলা নাই, যদিও একটা নরম গোছের হাড় আছে। এই হাড় সমুদ্রের ধারে অনেক দেখিতে পাওয়া যায়। সাদা-সাদা শশা বিচির মতন আকৃতি, কিন্তু শশা বিচির চাইতে ঢের বড়। এক ইঞ্চি হইতে আট ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হাড় সচরাচর দেখা যায়। অন্যান্য জন্তুর হাড়ের মতন ইহা তত মজবুত নহে। কতকটা খড়ির মতন সহজেই গুঁড়া হইয়া যায়। সাধারণ লোকে যত্নপূর্বক এই হাড় কুড়াইয়া আনে, বাজারে বিক্রয়ও করে। এই হাড়ে নাকি অনেক ভালোভালো ঔষধ প্রস্তুত হয়। ইহার চলিত নাম ‘সমুদ্রের ফেনা’। অনেকের বিশ্বাস, সমুদ্রের ফেনা জমিয়া এই জিনিস জন্মায়। আসলে অবশ্য তাহা নহে, ইহা কট্‌ল্‌ ফিশের হাড়। ইংরাজিতে এ জিনিসকে ‘কট‌্ল‌্ বোন‌্’ (cuttle bone) বলে।