পাতা:কবিকঙ্কণ চণ্ডী (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কবিকঙ্কণের নিজের পুথির বিবরণ Nòt নদীতীর যেন অফুরন্ত বঙ্গ জীবনের ভাণ্ডার খুলিয়া আমাদের চক্ষের সামনে প্ৰতিফলিত হইতেছে, অপর দিকে সুবৰ্ণ গোধিকারূপধারিণী চণ্ডীদেবীর সহসা দশভূজারূপ ধারণ, ছাগ রক্ষণে নিযুক্ত খুল্লনার সম্মুখে বনের উপান্তে সহসা বসন্ত ঋতুর আবির্ভাব, সুশীলার বারমাসী প্রভৃতি বিবিধ চিত্রে সংস্কৃত শব্দের সোনার রং যেন ঝলমল করিতেছে। সুতরাং কবিকঙ্কণ প্রাচীন ও নূতন যুগের সন্ধিস্থলের কবি। তিনি যেমন পল্লীজীবনের কবি, তেমনি সংস্কৃত যুগের নূতন দীপ্তিও তাঁহার লেখনীমুখে বারম্বার খেলিতেছে। এই শুভযোগ বঙ্গসাহিত্যের কতকটা হরগৌরী মিলনের ন্যায় সুন্দর হইয়াছে। একদিকে তৈল বিনা চুল শুকাইয়া জটা হইয়াছে ; গায়ে ছাই-মাটি, অথচ তাহা হইতে স্বভাব-সৌন্দর্ঘ্যের আভা ফুটিয়া বাহির হইতেছে, পাড়াগায়ের জঙ্গলের মধ্যে বিষাক্ত সাপ ছুটিতেছে ও কুলু কুলু ধ্বনি করিয়া সুরতরঙ্গিণী নৰ্ত্তকীর ন্যায় মন হরণ করিতেছে —‘অপর দিকে বেনারসী শাড়ীর স্বর্ণ বর্ণ ঝলমল করিয়া উঠিতেছে,--- পাদপদ্মে রক্ত শতদল ও আলতার লাল রং চক্ষু ঝলসিয়া দিতেছে, এবং মুকুটে হারে, কেউর-কঙ্কণ ও নূপুরে শত শত মুণিমুক্তার দীপ্তি চক্ষু ধাধিয়া দিতেছে। একদিকে দুঃখের শাশানভূমিতে তপস্বী ও তপস্বিনীগণের যোগশান্ত সহিষ্ণুতা,—অপর দিকে সৌন্দর্ঘ্যের লীলায়িত কমনীয় মূৰ্ত্তি। সমস্ত কাব্য জুড়িয়া মাতৃভক্তির অর্ঘ্য ও ভক্তের সাশ্রু নিবেদন ; সমস্ত কাব্য জুড়িয়া দিগৃবিদিগৃ-জ্ঞান-শূন্য সন্তানের জন্য ঐকান্তিক চেন্টা-নিরতা মাতৃশিক্তি। তখন বঙ্গদেশ ব্যাপিয়া অত্যাচারের ঘনঘটা ; সেই দুৰ্য্যোগে বঙ্গীয় পল্লীসমূহ খরথয় কঁাপিতেছিল। পল্লীবাসীরা ঝটিকা-তাড়িত ফুলগুলির ন্যায় নিজদিগকে নিতান্ত নিঃসহায় মনে করিতেছিল । তখন আৰ্ত্ত হৃদয়ে “মা” “মা” । বলিয়া একটা আকুল ক্ৰন্দন ও আৰ্ত্তনাদ জাগিয়া উঠিয়াছিল ; সেই আৰ্ত্তনাদে মাতৃহৃদয়ে করুণা শত ধারায় উদ্বেলিত হইয়া, যে উপায়ে হউৎ "সেই উপায়. সন্তানকে অভয়বাণী প্ৰদান পূর্বক সন্তানের ডাকে সাড়া দিয়া উঠিয়াছিল। সহস্ৰ প্ৰকার গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট হইয়াও বঙ্গীয় শক্তি-পূজা এইরূপ উজ্জ্বল ভাবে আমাদিগকে দেখা দিয়াছিল। সেই “মা” “মা” ডাকের আকুলতা এবং মাতৃহৃদয়ের স্নেহপূর্ণ সাড়া পরিণামে রামপ্রসাদের গানে পূর্ণতা লাভ করিয়াছিল। যাহা হউক এবিষয়ে আর বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করিবার অবকাশ নাই ।