পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রগতিসংহার
৮৭১

পড়ায় সুরীতি তাকে এগিয়ে থাকত, মুখস্থ বিদ্যেয় সে ছিল ওস্তাদ। কিন্তু পাঠ্যের বাইরে ছিল নীহারের প্রচুর পড়াশুনা। সুরীতি একেবারে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে ছুটে গোবিন্দবাবুর ঘরে গিয়ে বললে, “রাস্তায় ঘাটে এরকম সম্ভাষণ আমার সহ্য হয় না।”

 নীহার বললে, “আমার অন্যায় হয়েছে। কাল থেকে ওকে বলব ‘মসীপুঞ্জিতবর্ণা’, কিন্তু সেটা কি বড্ড বেশি রিয়ালিস্টিক হবে না।”

 সুরীতি প্রায় কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলে গেল।

 নীহারের চরিত্রে একটা নিরেট নিষ্ঠুরতা ছিল। যথোপযুক্ত ঘুষ দিয়ে তবে সেটাকে শান্ত করা যেত। এ কথা সবাই জানে।

 একদিন নীহার জাপানি খেলনা—কট্‌কটে-আওয়াজ-করা কাঠের ব্যাঙ দিয়ে ছেলেদের পকেট ভর্তি করে আনলে। ঠিক যে সময়ে প্লেটোর দার্শনিকতত্ত্ব ব্যাখ্যা করবার পালা এল— সমস্ত ক্লাসে কট্‌কট্ কট্‌কট্ শব্দ পড়ে গেল। শব্দটা যে কোথা থেকে হচ্ছে তাও স্পষ্ট বোঝা শক্ত। সেদিন কট্‌কটে ব্যাঙের শব্দে প্লেটোর কণ্ঠ একেবারে ডুবে গেল। শেষকালে খানাতল্লাসি করে দেখা গেল, দশটা কাঠের ব্যাঙ সুরীতির ডেস্কের ভিতরে।

 সে চীৎকার করে বলে উঠল, “এ কখনো আমার নয়। অন্যরা কেউ আমার ডেস্কে দুষ্টুমি করে ভরে রেখেছে।”

 ছেলেরা মহা তেরিয়া হয়ে বলে উঠল, “আমাদের উপর এ রকম অন্যায় দোষ দিলে আমরা সইতে পারব না। এ রকম ছেলেমানুষি খেলবার শখ কখনো পুরুষদের হতেই পারে না। এ-সমস্ত মেয়েদেরই খুকির ধর্ম।”

 কিছুক্ষণ ক্লাসঘর নীরব। তারপরে হঠাৎ অপর কোণ থেকে অদ্ভুত শব্দ উঠল, একসঙ্গে সব ছেলেরা পা ঘষতে শুরু করেছে সিমেণ্টের উপর। এতগুলো জুতো ঘষার শব্দে একটা উৎকট কন্‌সার্টের সৃষ্টি হল। ক্রমশ মাত্রা ছাড়িয়ে গেল, সুরীতির পক্ষে আর চুপ করে বসে থাকা চলল না। কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরে রইল, এক সময়ে হঠাৎ দড়াম করে একটা শব্দ হওয়ার পর ছেলেরা উঃ হুঃ শব্দে সানাইয়ের আওয়াজ নকল করতে লাগল।

 তখন সুরীতি বলে উঠল, “সার, অনগ্রহ করে ওদের গোলমাল করতে বারণ করবেন কি। আমরা এখানে পড়তে এসেছি, কিন্তু সংগীতচর্চার জায়গা এটা নয়। যদি কারও ক্লাস করতে ইচ্ছে না হয়, তবে ক্লাস ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।”

 সঙ্গে সঙ্গে চার দিক থেকে রব উঠল ‘শেম’ ‘শেম’ এবং লেফ্‌ট্‌ রাইট মার্চ্ করতে করতে ছেলেরা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সেদিনকার মতো ক্লাস আর জমল না। মেয়েরা যখন ক্লাস থেকে বেরিয়ে কমন্‌রুমে বসেছে, একটি পিয়ন এসে খবর দিল— সুরীতিকে সেক্রেটারি বাবু ডেকেছেন। মেয়েরা সব কানাকানি করতে লাগল। সুরীতি সেক্রেটারির ঘরে ঢুকে দেখলে সেখানে তাদের সেদিনকার প্রফেসার বসে আছেন আর নীহার পাশে দাঁড়িয়ে। সেক্রেটারি সুরীতিকে বললেন, “ছেলেরা, নালিশ করেছে তোমার আজকের ব্যবহারে তারা অপমান বোধ করেছে। তোমার দিক থেকে যদি কিছু বলবার থাকে তো বলো।”

 সুরীতি বললে, “সার, ওরা যে প্রফেসারের সঙ্গে অপমানজনক ব্যবহার করল,