পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৯৪
গল্পগুচ্ছ

জায়গাটাতেই সোনার খনির খবর পেয়েছি। কখনও স্পষ্ট যখন চোখোচোখি হয়েছে আমার বিশ্বাস সেটাকে চার চোখের অপঘাত বলে ওর ধারণা হয় নি। এক-একদিন হঠাৎ পিছন ফিরে দেখেছি আমার তিরোগমনের দিকে অচিরা তাকিয়ে আছে, ধরা পড়তেই দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

 তথ্যসংগ্রহের কাজে লাগলাম। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কেম্‌ব্রিজের সতীর্থ প্রোফেসর আছেন বঙ্কিম। তাঁকে চিঠি লিখলুম, ‘তোমাদের বেহার সিভিল সার্ভিসে আছেন এক ভদ্রলোক, নাম ভবতোষ। আমার কোনো বন্ধু তাঁর মেয়ের জন্যে লোকটিকে উদ্‌বাহবন্ধনে জড়াবার দুষ্কর্মে সাহায্য করতে আমাকে অনুরোধ করেছেন। জানতে চাই রাস্তা খোলসা কি না, আর লোকটার মতিগতি কী রকম।’

 উত্তর এল, ‘পাকা দেয়াল তোলা হয়ে গেছে, রাস্তা বন্ধ। তার পরেও লোকটার মতিগতি সম্বন্ধে যদি কৌতূহল থাকে তবে শোনো।— এ দেশে থাকতে আমি যাঁর ছাত্র ছিলুম তাঁর নাম নাই জানলে। তিনি পরম পণ্ডিত আর ঋষিতুল্য লোক। তাঁর নাতনিটিকে যদি দেখ তা হলে জানবে সরস্বতী কেবল যে আবির্ভূত হয়েছেন অধ্যাপকের বিদ্যামন্দিরে তা নয়, তিনি দেহ নিয়ে এসেছেন তাঁর কোলে। এমন বুদ্ধিতে উজ্জ্বল অপরূপ সুন্দর চেহারা কখনও দেখি নি।

 ‘ভবতোষ ঢুকল শয়তান তাঁর স্বর্গলোকে। স্বল্পজল নদীর মতো বুদ্ধি তার অগভীর ব’লেই জ্বল্ জ্বল্ করে আর সেই জন্যেই তার বচনের ধারা অনর্গল। ভুললেন অধ্যাপক, ভুললেন নাতনি। রকসকম দেখে আমাদের তো হাত নিস্‌পিস্ করতে থাকত। কিছু বলবার পথ ছিল না—বিবাহের সম্বন্ধ পাকাপাকি, বিলেত গিয়ে সিভিলিয়ান হয়ে আসবে তারই ছিল অপেক্ষা। তারও পাথেয় এবং খরচ জুগিয়েছেন কন্যার পিতা। লোকটার সর্দির ধাত, একান্ত মনে কামনা করেছিলাম ন্যুমোনিয়া হবে। হয় নি। পাস করলে পরীক্ষায়; দেশে ফেরবামাত্রই বিয়ে করলে ইন্‌ডিয়া গবর্মে‌ণ্টের উচ্চপদস্থ মুরুব্বির মেয়েকে। লোকসমাজে নাতনির লজ্জা বাঁচাবার জন্যে মর্মাহত অধ্যাপক কোথায় অন্তর্ধান করেছেন জানি নে। অনতিকালের মধ্যে ভবতোষের অপ্রত্যাশিত পদোন্নতির সংবাদ এল। মস্ত একটা বিদায়ভোজের আয়োজন হল। শুনেছি খরচটা দিয়েছে ভবতোষ গোপনে নিজের পকেট থেকে। আমরাও নিজের পকেট থেকেই খরচ দিয়ে গুণ্ডা লাগিয়ে ভোজটা দিলুম লণ্ডভণ্ড করে। কাগজে কংগ্রেসওয়ালাদের প্রতিই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল ভবতোষেরই ইশারায়। আমি জানি এই সৎকার্যে তারা লিপ্ত ছিল না। যে নাগরা জুতো লেগেছিল পলায়মানের পিঠে, সেটা অধ্যাপকেরই এক প্রাক্তন ছাত্রের প্রশস্ত পায়ের মাপে। পুলিস এল গোলমালের অনেক পরে—ইনস্পেক্টর আমার বন্ধু, লোকটা সহৃদয়।’

 চিঠিখানা পড়লুম, প্রাক্তন ছাত্রটির প্রতি ঈর্ষা হল।


অচিরার সঙ্গে প্রথম কথাটি শুরু করাই সব চেয়ে কঠিন কাজ। আমি বাঙালি মেয়েকে ভয় করি। বোধ করি চেনা নেই বলেই। অথচ কাজে যোগ দেব কিছু আগেই কলকাতায় কাটিয়ে এসেছি। সিনেমামঞ্চপথবর্তিনী বাঙালি মেয়ের নতুন-চাষ-করা ভ্রূবিলাস দেখে তো স্তম্ভিত হয়েছি— তারা সব জাতবান্ধবী—থাক্