পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছোটো গল্প
৮৯৫

তাদের কথা। কিন্তু অচিরাকে দেখলুম এ কালের ঠেলাঠেলি ভিড়ের বাইরে—নির্মল আত্মমর্যাদায়, স্পর্শভীরু মেয়ে।

 আমি তাই ভাবছি প্রথম কথাটি শুরু করব কী করে।

 জনরব এই-যে কাছাকাছি ডাকাতি হয়ে গেছে। ভাবলুম, হিতৈষী হয়ে বলি ‘রাজা-বাহাদুরকে বলে আপনার জন্যে পাহারার বন্দোবস্ত করে দিই।’ ইংরেজ মেয়ে হলে হয়তো গায়ে-পড়া আনুকূল্য সইতে পারত না, মাথা বাঁকিয়ে বলত ‘সে ভাবনা আমার’। এই বাঙালি মেয়ে অচেনার কাছ থেকে কী ভাবে কথাটা নেবে আমার জানা নেই, হয়তো আমাকেই ডাকাত বলে সন্দেহ করবে।

 ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটল সেটা উল্লেখযোগ্য।

 দিনের আলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অচিরার সময় হয়েছে ঘরে ফেরবার। এমন সময়ে একটা হিন্দুস্থানী গোঁয়ার এসে তার হাত থেকে তার খাতা আর থলিটা নিয়ে যখন ছুটেছে আমি তখনই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললুম, “কোনো ভয় নেই আপনার।” এই ব’লে ছুটে সেই লোকটার ঘাড়ের উপর পড়তেই সে ব্যাগ খাতা ফেলে দৌড় মারলে। আমি লুঠের মাল নিয়ে এসে অচিরাকে দিলুম। অচিরা বললে, “ভাগ্যিস আপনি—”

 আমি বললেম, “আমার কথা বলবেন না, ভাগ্যিস ঐ লোকটা এসেছিল।”

 “তার মানে!”

 “তার মানে তারই কৃপায় আপনার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়ে গেল।”

 অচিরা বিস্মিত হয়ে বললে, “কিন্তু ও যে ডাকাত!”

 “এমন অন্যায় অপবাদ দেবেন না। ও আমার বরকন্দাজ, রামশরণ।”

 অচিরা মুখের উপর খয়েরি রঙের আঁচল টেনে নিয়ে খিল্‌খিল্ করে হেসে উঠল। হাসি থামতে চায় না। কী মিষ্টি তার ধ্বনি। যেন ঝর্‌নার নীচে নুড়িগলো ঠন্‌ঠুন্ করে উঠল সুরে সুরে। হাসি-অবসানে সে বললে, “কিন্তু সত্যি হলে খুব মজা হত।”

 “মজা কার পক্ষে?”

 “যাকে নিয়ে ডাকাতি।”

 “আর উদ্ধারকর্তার?”

 “বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাকে এক পেয়ালা চা খাইয়ে দিতুম আর গোটা দুয়েক স্বদেশী বিস্কুট।”

 “আর এই ফাঁকি উদ্ধারকর্তার কী হবে।”

 “যে রকম শোনা গেল তাঁর তো আর কিছুতে দরকার নেই, কেবল প্রথম কথাটা।”

 “ঐ প্রথম পদক্ষেপেই গণিতের অগ্রগতিটা কি বন্ধ হবে।”

 “কেন হবে। ওকে চালাবার জন্যে বরকন্দাজের সাহায্য দরকার হবে না।”

 বসলুম সেখানেই ঘাসের উপরে। একটা কাটা গাছের গুঁড়ির উপরে বসে ছিল অচিরা। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “আপনি হলে আমাকে প্রথম কথাটা কী বলতেন।”

 “বলতুম রাস্তায় ঘাটে ঢেলা কুড়িয়ে কুড়িয়ে করছেন কী। আপনার কি বয়স হয় নি।”