পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছোটো গল্প
১০১

পড়েন না। কচ ও দেবযানী বলে একটা কবিতা আছে। তার শেষ কথাটা এই, মেয়েদের ব্রত পুরুষকে বাঁধা আর পুরুষের ব্রত মেয়ের বাঁধন কাটিয়ে স্বর্গলোকের রাস্তা বানানো। কচ বেরিয়ে পড়েছিল দেবযানীর অনুরোধ এড়িয়ে, আর আপনি মায়ের অনুনয়— একই কথা।”

 আমি বললুম, “দেখন, আমি হয়তো ভুল করেছিলাম। মেয়েদের নিয়ে পুরুষের কাজ যদি না চলে, তা হলে মেয়েদের সৃষ্টি কেন।”

 অচিরা বললে, “বারো-আনার চলে মেয়েরা তাদের জন্যেই। কিন্তু বাকি মাইনরিটি, যারা সব-কিছু পেরিয়ে নতুন পথের সন্ধানে বেরিয়েছে, তাদের চলে না। সব-পেরোবার মানষকে মেয়েরা যেন চোখের জল ফেলে রাস্তা ছেড়ে দেয়। যে দুর্গম পথে মেয়ে-পুরুষের চিরকালের দ্বন্দ্ব সেখানে পুরুষেরা হোক জয়ী। যে মেয়েরা মেয়েলি, প্রকৃতির বিধানে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি, তারা ছেলে মানুষ করে, সেবা করে ঘরের লোকের। যে পুরুষ যথার্থ পুরুষ, তাদের সংখ্যা খুব কম; তারা অভিব্যক্তির শেষ কোঠায়। মাথা তুলছে দুটি-একটি করে। মেয়েরা তাদের ভয় পায়, বুঝতে পারে না, টেনে আনতে চায় নিজের অধিকারের গণ্ডিতে। এই তত্ত্ব শুনেছি আমার দাদুর কাছে।—

 “দাদু, তোমার পড়া রেখে আমার কথা শোনো। মনে আছে?—তুমি একদিন বলেছিলে, পুরুষ যেখানে অসাধারণ সেখানে সে নিরতিশয় একলা, নিদারুণ তার নিঃসঙ্গতা, কেননা তাকে যেতে হয় যেখানে কেউ পৌঁছয় নি। আমার ডায়ারিতে লেখা আছে।”

 অধ্যাপক মনে করবার চেষ্টা করে বললেন, “বলেছিলুম নাকি। হয়তো বলেছিলুম।”

 অচিরা খুব বড়ো কথাও কয় হাসির ছলে, আজ সে অত্যন্ত গম্ভীর।

 খানিক বাদে আবার সে বললে, “দেবযানী কচকে কী অভিসম্পাত দিয়েছিল জানেন?”

 “না।”

 “বলেছিল, তোমার সাধনায় পাওয়া বিদ্যা তোমার নিজের ব্যবহারে লাগাতে পারবে না। যদি এই অভিসম্পাত আজ দিত দেবতা য়ুরোপকে, তা হলে য়ুরোপ বেঁচে যেত। বিশ্বের জিনিসকে নিজের মাপে ছোটো করেই ওখানকার মানুষ মরছে লোভের তাড়ায়।— সত্যি কি না বলো দাদু!”

 “খুব সত্যি, কিন্তু এত কথা কী করে ভাবলে।”

 “নিজের বুদ্ধিতে না। একটা তোমার মহদ্‌গুণ আছে, কখন কাকে কী যে বল, ভোলানাথ তুমি সব ভুলে যাও। তাই চোরাই মালের উপর নিজের ছাপ লাগিয়ে দিতে ভাবনা থাকে না।”

 আমি বললুম, “নিজের ছাপ যদি লাগে তা হলেই অপরাধ খণ্ডন হয়।”

 “জানেন, নবীনবাবু, ওঁর কত ছাত্র ওঁর কত মুখের কথা খাতায় টুকে নিয়ে বই লিখে নাম করেছে? উনি তাই পড়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশংসা করেছেন, বুঝতেই পারেন নি নিজের প্রশংসা নিজেই করছেন। কোন কথা আমার কথা আর কোন কথা ওঁর নিজের, সে ওঁর মনে থাকে না— লোকের সামনে আমাকে বলে বসেন