পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছোটো গল্প
১০৩

কখনও বা পদশব্দ কল্পনা করছি, কখনও বা হতাশ হয়ে ভাবছি অসমাপ্ত রিপোর্টের কথা। সুবিধে এই অধ্যাপক জিগ্‌গেসাই করেন না কোথাও আমার ঠেকছে কি না। তিনি ভাবেন সমস্তই জলের মতো সোজা। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ উপলক্ষে প্রশ্ন করেন, ‘আপনারও কি এই মনে হয় না।’ আমি খুব জোরের সঙ্গে বলি, ‘নিশ্চয়!’

 ইতিমধ্যে কিছুদুরে আমাদের অর্ধসমাপ্ত কয়লার খনিতে মজুরদের হল স্ট্রাইক। ঘটালেন যিনি, এই তাঁর ব্যাবসা, স্বভাব এবং অভাব-বশত; সমস্ত কাজের মধ্যে এইটেই সব চেয়ে সহজ। কোনো কারণ ছিল না— কেননা আমি নিজে সোশালিস্ট্, সেখানকার বিধিবিধান আমার নিজের হাতে বাঁধা, কারও সেখানে না ছিল লোকসান, না ছিল অসম্মান।

 নূতন যন্ত্র এসেছে জর্মান থেকে, তারই খাটাবার চেষ্টায় ব্যস্ত আছি। এমন সময় উত্তেজিতভাবে এসে উপস্থিত অচিরা। বললে, “আপনি মোটা মাইনে নিয়ে ধনিকের নায়েবি করছেন, এ দিকে গরিবের দারিদ্র্যের সুযোগটাকে নিয়ে আপনি—”

 চন্ করে উঠল মাথা। বাধা দিয়ে বললুম, “কাজ চালাবার দায়িত্ব এবং ক্ষমতা যাদের তারাই অন্যায়কারী আর জগতে যারা কোনো কাজই করে না, করতে পারেও না, দয়ামায়া কেবল তাদেরই— এই সহজ অহংকারের মত্ততায় সত্য-মিথ্যার প্রমাণ নিতেও মন চায় না।”

 অচিরা বললে, “সত্য নয় বলতে চান?”

 আমি বললুম, “সত্য শব্দটা আপেক্ষিক। যা-কিছু যত ভালোই হোক, তার চেয়ে আরও ভালো হতেও পারে। এই দেখুন না আমার মোটা মাইনে বটে, তার থেকে মাকে পাঠাই পঞ্চাশ, নিজে রাখি ত্রিশ, আর বাকি—সে হিসেবটা থাক্। কিন্তু মার জন্যে পনেরো নিজের জন্যে পাঁচ রাখলে আইডিয়ালের আরও কাছ ঘেঁষে যেত, কিন্তু একটা সীমা আছে তো।”

 অচিরা বললে, “সীমাটা কি নিজের ইচ্ছের উপরেই নির্ভর করে।”

 আমি বললুম, “না, অবস্থার উপরে। যে কথাটা উঠল সেটা একটু বিচার করে দেখুন। য়ুরোপে ইণ্ডস্টিয়ালিজম্ গড়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে। যাদের হাতে টাকা ছিল এবং টাকা করবার প্রতিভা ছিল তারাই এটা গড়েছে। গড়েছে নিছক টাকার লোভে— সেটা ভালো নয় তা মানি। কিন্তু ঐ ঘুষটকু যদি না পেত তা হলে একেবারে গড়াই হত না। এতদিন পরে আজ ওখানে পড়েছে হিসেবনিকেশের তলব।”

 অচিরা বললে, “আপনি বলতে চান পায়ে তেল শুরুতে, কানমলা তার পরে?”

 “নিশ্চয়। আমাদের দেশে ভিত গাঁথা সবে আরম্ভ হয়েছে, এখনই যদি মার লাগাই তা হলে শুরুতেই হবে শেষ—সুবিধে হবে বিদেশী বণিকদের। মানছি আজ আমি লোভীদের ঘুষ দেওয়ার কাজ নিয়েছি, টাকাওয়ালার নায়েবি আমি করি। আজ সেলাম করছি বাদশার দরবারে এসে, কাল ওদের সিংহাসনের পায়ায় লাগাব কুড়ল। ইতিহাসে তো এই দেখা গেছে।”

 অচিরা বললে, সব বঝলুম। কিন্তু আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করে আছি দেখতে, এই স্ট্রাইক মেটাতে আপনি নিজে কবে যাবেন। নিশ্চয়ই আপনাকে ডাকও পড়েছিল। কিন্তু কেন যান নি।”