“কী বলছ দিদি।”
“সত্যি কথাই বলছি। তুমি শিক্ষাদানযজ্ঞের হোতা, এখানে এনে আমি তোমাকে করেছি শুধু গ্রন্থকীট। বিশ্বসৃষ্টি বাদ দিলে কী দশা হয় বিশ্বকর্তার? ছাত্র না থাকলে তোমার হয় ঠিক তেমনি। সত্যি কথা বলো।”
“বরাবর ইস্কুলমাস্টারি করে এসেছি কিনা।”
“তুমি আবার ইস্কুলমাস্টার! কী যে বল তুমি! তুমি যে স্বভাবতই আচার্য। দেখেন নি নবীনবাবু?—ওঁর মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে কি, আর দয়ামায়া থাকে না। অমনি আমাকে নিয়ে পড়েন— বারো-আনাই বুঝতেই পারি নে। নইলে হাতড়িয়ে বের করেন এই নবীনবাবুকে, সে হয় আরও শোচনীয়। দাদু, ছাত্র তোমার নিতান্তই চাই জানি, কিন্তু বাছাই করে নিয়ো, রূপকথার রাজা সকালে ঘুম থেকে উঠেই যার মুখ দেখত তাকেই কন্যা দান করত। তোমার বিদ্যাদান অনেকটা সেই রকম।”
“না দিদি, আমাকে বাছাই করে নেয় যারা তারাই সাহায্য পায় আমার। এখনকার দিনে কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাত্র সংগ্রহ করে, আগেকার দিনে সন্ধান করে শিক্ষক লাভ করত শিক্ষার্থী।”
“আচ্ছা, সে কথা পরে হবে। এখনকার সিদ্ধান্ত এই যে, তোমাকে তোমার সেই কাজটা ফিরিয়ে নিতে হবে।”
অধ্যাপক হতবুদ্ধির মতো নাতনির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
অচিরা বললে, “তুমি ভাবছ, আমার গতি কী হবে। আমার গতি তুমি। আর আমাকে ছাড়লে তোমার কী গতি জানই তো। এখন যে তোমার পনেরোই আশ্বিনে পনেরোই অক্টোবরে এক হয়ে যায়, নিজের নূতন ছাতার সঙ্গে পরের পুরোনো ছাতার স্বত্বাধিকারে ভেদজ্ঞান থাকে না, গাড়ি চ’ড়ে ড্রাইভারকে এমন ঠিকানা বাতলিয়ে দাও সেই ঠিকানায় আজ পর্যন্ত কোনো বাড়ি তৈরি হয় নি, আর চাকরের ঘুম ভাঙবার ভয়ে সাবধানে পা টিপে টিপে কলতলায় নিজে গিয়ে কুঁজোয় জল ভরে নিয়ে আস।”
অধ্যাপক আমার দিকে চেয়ে বললেন, “তুমি কী বল নবীন?”
কী জানি ওঁর হয়তো মনে হয়েছিল ওঁদের এই পারিবারিক প্রস্তাবে আমার ভোটেরও একটা মূল্য আছে।
আমি খানিক ক্ষণ চুপ করে রইলুম, তার পরে বললুম, “অচিরাদেবীর চেয়ে সত্য পরামর্শ আপনাকে কেউ দিতে পারবে না।”
অচিরা তখনই উঠে দাঁড়িয়ে পা ছুঁয়ে আমাকে প্রণাম করলে। বোধ হল যেন চোখ থেকে জল পড়ল আমার পায়ে। আমি সংকুচিত হয়ে পিছু হটে গেলুম।
অচিরা বললে, “সংকোচ করবেন না। আপনার তুলনায় আমি কিছুই নই, সে কথা নিশ্চয় জানবেন। এই কিন্তু শেষ বিদায় যাবার আগে আর দেখা হবে না।”
অধ্যাপক বিস্মিত হয়ে বললেন, “সে কী কথা দিদি।”
অচিরা বাষ্পগদ্গদ কণ্ঠ সামলিয়ে হেসে বললে, “দাদু, তুমি অনেক কিছু জান, কিন্তু আরও-কিছু সম্বন্ধে আমার বুদ্ধি তোমার চেয়ে অনেক বেশি এ কথাটা মেনে নিয়ো।”