পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৮৮
গল্পগুচ্ছ

 “হাঁ, বেচব, আশ্চর্য হও কেন।”

 বিভা মূহূর্ত কাল স্তব্ধ থেকে বললে, “এই ঘড়ি যে মনীষা তোমাকে জন্মদিনে দিয়েছিল। মনে হচ্ছে তার বুকের ব্যথা এখনও ওর মধ্যে ধুক্‌ধুক্ করছে। জান সে কত দুঃখ পেয়েছিল, কত নিন্দে সয়েছিল আর কত দুঃসাধ্য অপব্যয় করেছিল উপহারটাকে তোমার উপযুক্ত করবার জন্যে?”

 অভীক বললে, “এ ঘড়ি সেই তো দিয়েছিল, কে দিয়েছে শেষ পর্যন্ত জানতেই দেয় নি। কিন্তু আমি তো পৌত্তলিক নই যে বুকের পকেটে এই জিনিসটার বেদি বাঁধিয়ে মনের মধ্যে দিনরাত শাঁখঘণ্টা বাজাতে থাকব।”

 “আশ্চর্য করেছ তুমি। এই ক’মাস হল সে টাইফয়েডে—”

 “এখন সে তো সংখদুঃখের অতীত।”

 “শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত সে এই বিশ্বাস নিয়ে মরেছিল যে তুমি তাকে ভালোবাসতে।”

 “ভুল বিশ্বাস করে নি।”

 “তবে?”

 “তবে আবার কী। সে নেই, কিন্তু তার ভালোবাসার দান আজও যদি আমাকে ফল দেয় তার চেয়ে আর কী হতে পারে।”

 বিভার মুখে অত্যন্ত একটা পীড়ার লক্ষণ দেখা দিল। একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, “এত দেশ থাকতে আমার কাছে বেচতে এলে কেন।”

 “কেননা জানি তুমি দর-কষাকষি করবে না।”

 “তার মানে কলকাতার বাজারে আমিই কেবল ঠকবার জন্যে তৈরি হয়ে আছি?”

 “তার মানে ভালোবাসা খুশি হয়ে ঠকে।”

 এমন মানুষের ’পরে রাগ করা শক্ত। জোরের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে ছেলেমানুষি। কিছুতে যে লজ্জার কারণ আছে তা যেন ও জানেই না। এই ওর অকৃত্রিম অবিবেক, এই-যে উচিত-অনুচিতের বেড়া অনায়াসে লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে চলা, এতেই মেয়েদের স্নেহ ওকে এত করে টানে। ভর্ৎসনা করবার জোর পায় না। কর্তব্যবোধকে যারা অত্যন্ত সামলে চলে মেয়েরা তাদের পায়ের ধুলো নেয়। আর যে-সব দুর্দাম দুরন্তের কোনো বালাই নেই ন্যায়-অন্যায়ের, মেয়েরা তাদের বাহুবন্ধনে বাঁধে।

 ডেস্কের ব্লটিঙ কাগজটার উপর খানিক ক্ষণ নীল পেনসিলের দাগ-কাটাকাটি করে শেষকালে বিভা বললে, “আচ্ছা, যদি আমার হাতে টাকা থাকে তবে অমনি তোমাকে দেব। কিন্তু তোমার ওই ঘড়ি আমি কিছুতেই কিনব না।”

 উত্তেজিত কণ্ঠে অভীক বললে, “ভিক্ষা! তোমার সমান ধনী যদি হতুম, তা হলে তোমার দান নিতুম উপহার বলে, দিতুম প্রত্যুপহার সমান দামের। আচ্ছা, পুরুষের কর্তব্য আমিই বরঞ্চ করছি। এই নাও এই ঘড়ি, এক পয়সাও নেব না।”

 বিভা বললে, “মেয়েদের তো নেবারই সম্বন্ধ। তাতে কোনো লজ্জা নেই। তাই ব’লে এ ঘড়ি নয়। আচ্ছা শুনি, কেন তুমি ওটা বিক্রি করছ।”

 “তবে শোনো, তুমি তো জান আমার অত্যন্ত বেহায়া একটা ফোর্ড্ গাড়ি আছে। সেটার চালচলনের ঢিলেমি অসহ্য। কেবল আমি বলেই ওর দশম দশা ঠেকিয়ে রেখেছি। আটশো টাকা দিলেই ওর বদলে ওর বাপদাদার বয়সী একটা পুরোনো