পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৬২
গল্পগুচ্ছ

 করুণা চলিল। উভয়ে স্টেশনে গিয়া উপস্থিত হইল। গাড়ি ছাড়িতে এখনও দেরি আছে। জিনিসপত্র পুঁটুলি-বোঁচকা লইয়া যাত্রিগণ মহা কোলাহল করিতেছে। কানে-কলম-গোঁজা রেলওয়ে ক্লার্কগণ ভারি উঁচু চালে ব্যস্তভাবে ইতস্ততঃ ফর্ ফর্ করিয়া বেড়াইতেছেন। পান সোডাওয়াটার নানাপ্রকার মিষ্টান্নের বোঝা লইয়া ফেরিওয়ালারা আগামী গাড়ির জন্য অপেক্ষা করিতেছে। এইরূপ তো অবস্থা। এমন সময়ে একজন পুরুষ করুণার পাশে সেই বেঞ্চে আসিয়া বসিল।

 করুণা উঠিয়া যাইবে-যাইবে করিতেছে, এমন সময়ে তাহার পার্শ্বস্থ পুরুষ বিস্ময়ের স্বরে কহিয়া উঠিল, “মা, তুমি যে এখানে!”

 করুণা পণ্ডিতমহাশয়ের স্বর শনিয়া চমকিয়া উঠিল। অনেকক্ষণ কিছু বলিতে পারিল না। অনেকক্ষণ নির্জল নয়নে চাহিয়া চাহিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, “সার্বভৌমমহাশয়, আমার ভাগ্যে কী ছিল!”

 পণ্ডিতমহাশয় তো আর অশ্রু সম্বরণ করিতে পারেন না। গদ্গদ স্বরে কহিলেন, “মা, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, তাহার জন্য আর ভাবিয়ো না। আমি প্রয়াগে যাইতেছি, আমার সঙ্গে আইস। পৃথিবীতে আর আমার কেহই নাই—যে কয়টা দিন বাঁচিয়া আছি ততদিন আমার কাছে থাকো, ততদিন আর তোমার কোনো ভাবনা নাই।”

 করুণা অধীর উচ্ছ্বাসে কাঁদিতে লাগিল। এমন সময়ে নিধি আসিয়া উপস্থিত হইল। নিধি পণ্ডিতমহাশয়ের খরচে কাশী দর্শন করিতে আসিয়াছেন। পণ্ডিতমহাশয় তজ্জন্য নিধির কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ আছেন। তিনি বলেন, নিধির ঋণ তিনি এ জন্মে শোধ করিতে পারিবেন না। করুণাকে দেখিয়া একেবারে চমকিয়া উঠিল; কহিল, “ভট্টাচার্য মহাশয়, একটা কথা আছে।”

 পণ্ডিতমহাশয় শশব্যস্তে উঠিয়া গেলেন। নিধি কহিল, “ঐ বাবুটিকে দেখিতেছেন?”

 পণ্ডিতমহাশয় চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন—স্বরূপ। নিধি কহিল, “দেখিলেন! করুণার ব্যবহারটা একবার দেখিলেন! ছি-হি, স্বর্গীয় কর্তার নামটা একেবারে ডুবাইল!”

 পণ্ডিতমহাশয় অনেকক্ষণ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন, অবশেষে হাত উল্টাইয়া আস্তে আস্তে কহিলেন—

“স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং পুরুষস্য ভাগ্যং
দেবা না জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ।”

 নিধি কহিল, “আহা, নরেন্দ্র এমন ভালো লোক ছিল। ওই রাক্ষসীই তো তাহাকে নষ্ট করিয়াছে।”

 নরেন্দ্র যে ভালো লোক ছিল সে বিষয়ে পণ্ডিতমহাশয়ের সংশয় ছিল না, এখন যে খারাপ হইয়া গিয়াছে তাহারও প্রমাণ পাইয়াছেন, কিন্তু এতক্ষণে কেন যে খারাপ হইয়া গিয়াছে তাহার কারণটা জানিতে পারিলেন। পণ্ডিতমহাশয়ের স্ত্রীজাতির উপর দারূণ ঘৃণা জন্মাইল। পণ্ডিতমহাশয় ভাবিলেন, আর না— স্ত্রীলোকেই তাঁহার সর্বনাশ করিয়াছে, স্ত্রীজাতিকে আর বিশ্বাস করিবেন না।