পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/২০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৭৯

মুকুট

প্রথম পরিচ্ছেদ

ত্রিপুরার রাজা অমরমাণিক্যের কনিষ্ঠ পুত্র রাজধর সেনাপতি ইশা খাঁকে বলিলেন, “দেখো সেনাপতি, আমি বার বার বলিতেছি, তুমি আমাকে অসম্মান করিয়ো না।”

 পাঠান ইশা খাঁ কতকগুলি তীরের ফলা লইয়া তাহাদের ধার পরীক্ষা করিতেছিলেন। রাজধরের কথা শুনিয়া কিছুই বলিলেন না, কেবল মুখ তুলিয়া ভুরু উঠাইয়া একবার তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন। আবার তখনই মুখ নত করিয়া তীরের ফলার দিকে মনোযোগ দিলেন।

 রাজধর বলিলেন, “ভবিষ্যতে যদি তুমি আমার নাম ধরিয়া ডাকো, তবে আমি তাহার সমুচিত প্রতিবিধান করিব।”

 বৃদ্ধ ইশা খাঁ সহসা মাথা তুলিয়া বজ্রস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “বটে!”

 রাজধর তাঁহার তলোয়ারের খাপের আগা মেঝের পাথরের উপরে ঠক্ করিয়া ঠুকিয়া বলিলেন, “হাঁ।”

 ইশা খাঁ বালক রাজধরের বুক-ফুলানোর ভঙ্গি ও তলোয়ারের আস্ফালন দেখিয়া থাকিতে পারিলেন না, হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। রাজধরের সমস্ত মুখ, চোখের সাদাটা পর্যন্ত লাল হইয়া উঠিল।

 ইশা খাঁ উপহাসের স্বরে হাসিয়া হাত জোড় করিয়া বলিলেন, “মহামহিম মহারাজাধিরাজকে কী বলিয়া ডাকিতে হইবে। হজুর, জনাব, জাঁহাপনা, শাহেন্‌ শা—”

 রাজধর তাঁহার স্বাভাবিক কর্কশ স্বর দ্বিগুণ কর্কশ করিয়া কহিলেন, “আমি তোমার ছাত্র বটে, কিন্তু আমি রাজকুমার— তাহা তোমার মনে নাই!”

 ইশা খাঁ তীব্রস্বরে কহিলেন, “বস্! চুপ! আর অধিক কথা কহিয়ো না। আমার অন্য কাজ আছে।”

 বলিয়া পুনরায় তীরের ফলার প্রতি মন দিলেন।

 এমন সময় ত্রিপুরার দ্বিতীয় রাজপুত্র ইন্দ্রকুমার তাঁহার দীর্ঘ প্রশস্ত বিপুল বলিষ্ঠ দেহ লইয়া গৃহে প্রবেশ করিলেন। মাথা হেলাইয়া হাসিয়া বলিলেন, “খাঁ-সাহেব, আজিকার ব্যাপারটা কী।”

 ইন্দ্রকুমারের কণ্ঠ শনিয়া বৃদ্ধ ইশা খাঁ তীরের ফলা রাখিয়া সস্নেহে তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন; হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “শোনো তো বাবা, বড়ো তামাসার কথা। তোমার এই কনিষ্ঠটিকে, মহারাজচক্রবর্তীকে, জাঁহাপনা জনাব বলিয়া না ডাকিলে উঁহার অপমান বোধ হয়!”

 বলিয়া আবার তীরের ফলা লইয়া পড়িলেন।

 “সত্য নাকি!”—বলিয়া ইন্দ্রকুমার হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।

 রাজধর বিষম ক্রোধে বলিলেন, “চুপ করো দাদা!”

 ইন্দ্রকুমার বলিলেন, “রাজধর, তোমাকে কী বলিয়া ডাকিতে হইবে। জাঁহাপনা! হা হা হা হা!”