পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/২০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৮০
গল্পগুচ্ছ

 রাজধর কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, “দাদা, চুপ করো বলিতেছি।”

 ইন্দ্রকুমার আবার হাসিয়া বলিলেন, “জনাব!”

 রাজধর অধীর হইয়া বলিলেন, “দাদা, তুমি নিতান্ত নির্বোধ।”

 ইন্দ্রকুমার হাসিয়া রাজধরের পৃষ্ঠে হাত বুলাইয়া বলিলেন, “ঠাণ্ডা হও ভাই, ঠাণ্ডা হও। তোমার বুদ্ধি তোমার থাক্, আমি তোমার বুদ্ধি কাড়িয়া লইতেছি না।”

 ইশা খাঁ কাজ করিতে করিতে আড়চোখে চাহিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “উহার বুদ্ধি সম্প্রতি অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে।”

 ইন্দ্রকুমার বলিলেন, “নাগাল পাওয়া যায় না!”

 রাজধর গস্ গস্ করিয়া চলিয়া গেলেন। চলনের দাপে খাপের মধ্যে তলোয়ারখানা ঝন্ ঝন্ করিতে লাগিল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

রাজকুমার রাজধরের বয়স উনিশ বৎসর। শ্যামবর্ণ, বেঁটে, দেহের গঠন বলিষ্ঠ। সেকালে অন্য রাজপত্রেরা যেমন বড়ো বড়ো চুল রাখিতেন, ইঁহার তেমন ছিল না। ইঁহার সোজা সোজা মোটা চুল ছোটো করিয়া ছাঁটা। ছোটো ছোটো চোখ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। দাঁতগুলি কিছু বড়ো। গলার আওয়াজ ছেলেবেলা হইতেই কেমন কর্কশ। রাজধরের বুদ্ধি অত্যন্ত বেশি এইরূপ সকলের বিশ্বাস, তাঁহার নিজের বিশ্বাসও তাই। এই বুদ্ধির বলে তিনি আপনার দুই দাদাকে অত্যন্ত হেয়জ্ঞান করিতেন। রাজধরের প্রবল প্রতাপে বাড়িসুদ্ধ সকলে অস্থির। আবশ্যক থাক্ না-থাক্, একখানা তলোয়ার মাটিতে ঠুকিয়া ঠুকিয়া তিনি বাড়িময় কর্তৃত্ব করিয়া বেড়ান। রাজবাটীর চাকর-বাকরেরা তাঁহাকে রাজা বলিয়া, মহারাজ বলিয়া, হাত জোড় করিয়া, সেলাম করিয়া, প্রণাম করিয়া, কিছুতে নিস্তার পায় না। সকল জিনিসেই তাঁহার হাত, সকল জিনিসই তিনি নিজে দখল করিতে চান। সে বিষয়ে তাঁহার চক্ষুলজ্জাটুকু পর্যন্ত নাই। একবার যুবরাজ চন্দ্রনারায়ণের একটা ঘোড়া তিনি রীতিমত দখল করিয়াছিলেন; দেখিয়া যুবরাজ ঈষৎ হাসিলেন, কিন্তু কিছু বলিলেন না। আর একবার কুমার ইন্দ্রকুমারের রূপার-পাত-লাগানো একটা ধনুক অম্লানবদনে অধিকার করিয়াছিলেন; ইন্দ্রকুমার চটিয়া বলিলেন, ‘দেখো, যে জিনিস লইরাছ উহা আমি আর ফিরাইরা লইতে চাহি না, কিন্তু ফের যদি তুমি আমার জিনিসে হাত দাও তবে আমি এমন করিয়া দিব যে, ও হাতে আর জিনিস তুলিতে পারিবে না।’ কিন্তু রাজধর দাদাদের কথা বড়ো গ্রাহ্য করিতেন না। লোকে তাঁহার আচরণ দেখিয়া আড়ালে বলিত, ‘ছোটোকুমারের রাজার ঘরে জন্ম বটে, কিন্তু রাজার ছেলের মতো কিছুই দেখি না।’

 কিন্তু মহারাজ অমরমাণিক্য রাজধরকে কিছু বেশি ভালোবাসিতেন। রাজধর তাহা জানিতেন। আজ পিতার কাছে গিয়া ইশা খাঁর নামে নালিশ করিলেন।

 রাজা ইশা খাঁকে ডাকাইয়া আনিলেন। বলিলেন, “সেনাপতি, রাজকুমারদের এখন বয়স হইয়াছে। এখন উহাদিগকে যথোচিত সম্মান করা উচিত।”

 “মহারাজ বাল্যকালে যখন আমার কাছে যুদ্ধ শিক্ষা করিতেন, তখন মহা-