পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/২১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মুকুট
৯৮৭

 ইন্দ্রকুমার তীর নিক্ষেপ করিলেন, লক্ষ্য বিদ্ধ হইল। বাজনা বাজিল। চারি দিকে জয়ধ্বনি উঠিল। যুবরাজ যখন ইন্দ্রকুমারকে আলিঙ্গন করিলেন, আনন্দে ইন্দ্রকুমারের চক্ষু ছল ছল করিয়া আসিল; ইশা খাঁ পরম স্নেহে কহিলেন, “পুত্র, আল্লার কৃপায় তুমি দীর্ঘজীবী হইয়া থাকো।”

 মহারাজা যখন ইন্দ্রকুমারকে পুরস্কার দিবার উদ্যোগ করিতেছেন এমন সময়ে রাজধর গিয়া কহিলেন, “মহারাজ, আপনাদের ভ্রম হইয়াছে। আমার তীর লক্ষ্যভেদ করিয়াছে।”

 মহারাজ কহিলেন, “কখনোই না।”

 রাজধর কহিলেন, “মহারাজ, কাছে গিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখুন।”

 সকলে লক্ষ্যের কাছে গেলেন। দেখিলেন, যে তীর মাটিতে বিদ্ধ তাহার ফলায় ইন্দ্রকুমারের নাম খোদিত, আর যে তীর লক্ষ্যে বিদ্ধ তাহাতে রাজধরের নাম ক্ষোদিত।

 রাজধর কহিলেন, “বিচার করুন মহারাজ!”

 ইশা খাঁ কহিলেন, “নিশ্চয়ই তূণ বদল হইয়াছে।”

 কিন্তু পরীক্ষা করিয়া দেখা গেল, তূণ বদল হয় নাই। সকলে পরস্পরের মুখ-চাওয়াচাওয়ি করিতে লাগিলেন।

 ইশা খাঁ কহিলেন, “পুনর্বার পরীক্ষা করা হউক।”

 রাজধর বিষম অভিমান করিয়া কহিলেন, “তাহাতে আমি সম্মত হইতে পারি না। আমার প্রতি এ বড়ো অন্যায় অবিশ্বাস। আমি তো পুরস্কার চাই না, মধ্যমকুমার-বাহাদুরকে পুরস্কার দেওয়া হউক।”

 বলিয়া পুরস্কারের তলোয়ার ইন্দ্রকুমারের দিকে অগ্রসর করিয়া দিলেন।

 ইন্দ্রকুমার দারুণ ঘৃণার সহিত বলিয়া উঠিলেন, “ধিক্! তোমার হাত হইতে এ পুরস্কার গ্রাহ্য করে কে। এ তুমি লও।”

 বলিয়া তলোয়ারখানা ঝন্ ঝন্ করিয়া রাজধরের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিলেন। রাজধর হাসিয়া নমস্কার করিয়া তাহা তুলিয়া লইলেন।

 তখন ইন্দ্রকুমার কম্পিতম্বরে পিতাকে কহিলেন, “মহারাজ, আরাকানপতির সহিত শীঘ্রই যুদ্ধ হইবে। সেই যুদ্ধে গিয়া আমি পুরস্কার আনিব। মহারাজ, আদেশ করুন।”

 ইশা খাঁ ইন্দ্রকুমারের হাত ধরিয়া কঠোরস্বরে কহিলেন, “তুমি আজ মহারাজের অপমান করিয়াছ। উঁহার তলোয়ার লইয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়াছ। ইহার সমুচিত শাস্তি আবশ্যক।”

 ইন্দ্রকুমার সবলে হাত ছাড়াইয়া লইয়া কহিলেন, “বৃদ্ধ, আমাকে স্পর্শ করিয়ো না।”

 বৃদ্ধ ইশা খাঁ সহসা বিষণ্ণ হইয়া ক্ষুব্ধ স্বরে কহিলেন, “পুত্র, একি পুত্র। আমার ’পরে এই ব্যবহার! তুমি আজ আত্মবিস্মৃত হইয়াছ বৎস!”

 ইন্দ্রকুমারের চোখে জল উথলিয়া উঠিল। তিনি কহিলেন, “সেনাপতিসাহেব, আমাকে মাপ করো, আমি আজ যথার্থই আত্মবিস্মত হইয়াছি।”

 যুবরাজ স্নেহের স্বরে কহিলেন, “শান্ত হও, ভাই—গৃহে ফিরিয়া চলো।”

 ইন্দ্রকুমার পিতার পদধূলি লইয়া কহিলেন, “পিতা। অপরাধ মার্জনা করুন।”