পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শেষ কথা
৮০৫

একটা অপূর্ব স্বরূপ ছিটকিনি খুলে অবারিত হয়, সেই আঘাত আমাকে লাগল কী করে! বরাবর জানি আমি পাহাড়ের মতো খট্‌খটে, নিরেট। ভিতর থেকে উছলে পড়ল ঝরনা।

 একটা-কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু মানুষের সঙ্গে সব চেয়ে বড়ো আলাপের প্রথম কথাটি কী হতে পারে ভেবে পাই নে। সে হচ্ছে খৃস্টীয় পুরাণের প্রথম সৃষ্টির বাণী— আলো জাগুক, অব্যক্ত হয়ে যাক ব্যক্ত। এক সময়ে মনে হল—মেয়েটি— ওর আসল নাম পরে জেনেছি কিন্তু সেটা ব্যবহার করব না, ওকে নাম দিলাম অচিরা। মানে কী। মানে এই, যার প্রকাশ হতে বিলম্ব হল না, বিদ্যুতের মতো। রইল ঐ নাম— মুখ দেখে মনে হল অচিরা জানতে পেরেছে কে একজন আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। উপস্থিতির একটা নীরব ধ্বনি আছে বুঝি! লেখা বন্ধ করেছে, অথচ উঠতে পারছে না। পলায়নটা পাছে বড্ড বেশি স্পষ্ট হয়। একবার ভাবলুম বলি, ‘মাপ করুন’—কী মাপ করা, কী অপরাধ, কী বলব তাকে। একটু তফাতে গিয়ে বিলিতি বেঁটে কোদাল নিয়ে মাটিতে খোঁচা মারবার ভান করলুম, ঝুলিতে একটা কী পুরলুম, সেটা অত্যন্ত বাজে। তার পরে ঝুঁকে পড়ে মাটিতে বিজ্ঞানী দৃষ্টি চালনা করতে করতে চলে গেলুম। কিন্তু নিশ্চয় মনে জানি, যাঁকে ভোলাবার চেষ্টা করেছিলুম তিনি ভোলেন নি। মুগ্ধ পুরুষচিত্তের দুর্বলতার আরও অনেক প্রমাণ তিনি আরও অনেকবার পেরেছেন, সন্দেহ নেই। আশা করলুম আমার বেলায় এটা তিনি মনে-মনে উপভোগ করেছেন। এর চেয়ে বেড়া আর অল্প-একটু যদি ডিঙোতুম, তা হলে— তা হলে কী হত কী জানি। রাগতেন, না রাগের ভান করতেন? অত্যন্ত চঞ্চল মন নিয়ে চলেছি আমার বাংলোঘরের পথে, এমন সময় আমার চোখে পড়ল দুই টুকরায় ছিন্ন করা একখানা চিঠির খাম। এটাকে জিয়লজিকাল নমুনা বলে না। তবু তুলে দেখলুম। নামটা ভবতোষ মজুমদার আই. সি. এস; ঠিকানা ছাপরা, মেয়েলি হাতে লেখা। টিকিট লাগানো আছে, তাতে ডাকঘরের ছাপ নেই। যেন কুমারীর দ্বিধা। আমার বিজ্ঞানী বুদ্ধি; স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, এই ছেঁড়া চিঠির খামের মধ্যে একটা ট্র্যাজেডির ক্ষতচিহ্ন আছে। পৃথিবীর ছেঁড়া স্তর থেকে তার বিপ্লবের ইতিহাস বের করা আমাদের কাজ। সেই আমার সন্ধানপটু হাত এই ছেঁড়া খামের রহস্য আবিষ্কার করতে সংকল্প করলে।

 ইতিমধ্যে ভাবছি নিজের অন্তঃকরণের রহস্য অভূতপূর্ব। এক-একটা বিশেষ অবস্থার সংস্পর্শে তার ভাবখানা কী যে একটা নতুন আকারে দানা বেঁধে দেখা দেয়, এবারে তার পরিচয়ে বিস্মিত হয়েছি। এতদিন যে মনটা নানা কঠিন অধ্যবসায় নিয়ে শহরে শহরে জীবনের লক্ষ্য-সন্ধানে ঘুরেছে, তাকে স্পষ্ট করে চিনেছিলুম। ভেবেছিলুম সেই আমার সতাকার স্বভাব, তার আচরণের ধ্রুবত্ব সম্বন্ধে আমি হলপ করতে পারতুম। কিন্তু তার মধ্যে বুদ্ধিশাসনের বহির ভূত যে-একটা মূঢ় লকিয়ে ছিল, তাকে এই প্রথম দেখা গেল। ধরা পড়ে গেল আরণ্যক, যে যুক্তি মানে না, যে মোহ মানে। বনের একটা মায়া আছে, গাছপালার নিঃশব্দ চক্রান্ত, আদিম প্রাণের মন্ত্রধ্বনি। দিনে দুপরে ঝাঁ ঝাঁ করে তার উদাত্ত সুর, রাতে দুপুরে মন্দ্রগম্ভীর ধ্বনি, গুঞ্জন করতে থাকে জীবচেতনায়— আদিম প্রাণের গূঢ় প্রেরণায় বুদ্ধিকে দেয় আবিষ্ট করে।