পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮১০
গল্পগুচ্ছ

করছিল স্নিগ্ধ কণ্ঠের এই আলাপ শীঘ্র যেন শেষ হয়ে না যায়। দিনের আলো ম্লান হয়ে এল। সন্ধ্যার প্রথম তারা জ্বলে উঠেছে শালবনের মাথার উপরে। সাঁওতাল মেয়েরা জ্বালানি-কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে ঘরে, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে তাদের গান।

 এমন সময় বাইরে থেকে ডাক এল, “দিদি, কোথায় তুমি। অন্ধকার হয়ে এল যে। আজকাল সময় ভালো নয়।”

 “ভালো তো নয়ই দাদু, তাই একজন রক্ষাকর্তা নিযুক্ত করেছি।”

 অধ্যাপক আসতেই তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলাম। তিনি শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। পরিচয় দিলাম, “আমার নাম নবীনমাধব সেনগুপ্ত।”

 বৃদ্ধের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, “বলেন কী, আপনিই ডাক্তার সেনগুপ্ত? আপনি তো ছেলেমানুষ।”

 আমি বললুম, “নিতান্ত ছেলেমানুষ। আমার বয়স ছত্রিশের বেশি নয়।”

 আবার অচিরার সেই কলমধুর কণ্ঠের হাসি, আমার মনে যেন দুনো লয়ের ঝংকারে সেতার বাজিয়ে দিলে। বললে, “দাদুর কাছে পৃথিবীর সবাই ছেলেমানুষ, আর দাদু হচ্ছেন সকল ছেলেমানুষের আগরওয়ালা।”

 অধ্যাপক বললেন, “আগরওয়ালা? একটা নতুন শব্দ বাংলায় আমদানি করলে! কোথা থেকে জোটালে?”

 “সেই যে তোমার ভালোবাসার মাড়োয়ারি ছাত্র, কুন্দনলাল আগরওয়ালা; আমাকে এনে দিত বোতলে করে আমের চাটনি; আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম আগরওয়ালা কথাটার মানে কী। সে বলেছিল পায়োনিয়র।”

 অধ্যাপক বললেন, “ডাক্তার সেনগুপ্ত, আপনার সঙ্গে আলাপ হল যদি, আমাদের ওখানে যেতে হবে তো।”

 “কিচ্ছু বলতে হবে না দাদু। যাবার জন্যে লাফালাফি করছেন। আমার কাছে শুনেছেন, দেশকালের একজোট তত্ত্ব নিয়ে তুমি ব্যাখ্যা করবে আইনস্টাইনের কাঁধে চড়ে।”

 মনে মনে বললুম, ‘সর্বনাশ! কী দুষ্টুমি!’

 অধ্যাপক অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে বললেন, “আপনার বুঝি ‘টাইম্‌-স্পেস’-এর—”

 আমি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলুম, “কিচ্ছু বুঝি নে ‘টাইম-স্পেস’এর। আমাকে বোঝাতে গেলে আপনার সময় নষ্ট হবে মাত্র।”

 বৃদ্ধ ব্যগ্র হয়ে বলে উঠলেন, “সময়! এখানে সময়ের অভাব কোথায়! আচ্ছা, এক কাজ করুন-না, আজকে নাহয় আমাদের ওখানে আহার করবেন— কী বলেন।”

 আমি লাফ দিয়ে বলতে যাচ্ছিলাম ‘এখ্‌খনি’।

 অচিরা বলে উঠল, “দাদু সাধে তোমাকে বলি ছেলেমানুষ। যখন-তখন নেমন্তন্ন করে তুমি আমাকে মুশকিলে ফেল। এই দণ্ডকারণ্যে ফিরপির দোকান পাব কোথায়। ওঁরা বিলেতের ডিনার-খাইয়ে জাতের সর্বগ্রাসী মানুষ— কেন তোমার নাতনির বদনাম করবে। অন্তত ভেটকিমাছ আর ভেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে তো।”

 “আচ্ছা আচ্ছা, তা হলে কবে আপনার সুবিধে হবে বলুন।”

 “সুবিধে আমার কালই হতে পারবে। কিন্তু অচিরা দেবীকে বিপন্ন করতে