পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পগুচ্ছ
৮১৪

 আবার মানতে হল, “হাঁ, প্রস্তাব তাঁর দিক থেকেই উঠেছিল।”

 “তবে?”

 “আমার কাজ যে ভারতবর্ষের। শুধু সে তো বিজ্ঞানের নয়।”

 “অর্থাৎ ভালোবাসার সফলতা আপনার মতো সাধকের কামনার জিনিস নয়। মেয়েদের জীবনের চরম লক্ষ্য ব্যক্তিগত, আপনাদের নৈর্ব্যক্তিক।”

 এ জবাবটা হঠাৎ মূখে এল না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে অচিরা বললে, “বাংলা সাহিত্য আপনি বোধ হয় পড়েন না। কচ ও দেবযানী বলে একটা কবিতা আছে। তাতে ঐ কথাই আছে, মেয়েদের ব্রত হচ্ছে পুরুষকে বাঁধা, আর পুরুষদের ব্রত সে বাঁধন কাটিয়ে অমরলোকের রাস্তা বানানো। কচ বেরিয়ে পড়েছিল দেবযানীর অনুরোধ এড়িয়ে, আপনি কাটিয়ে এসেছেন মায়ের অনুনয়। একই কথা। মেয়েপুরুষের এই চিরকালের দ্বন্দ্বে আপনি জয়ী হয়েছেন। জয় হোক আপনার পৌরুষের। কাঁদুক মেয়েরা, সে কান্না আপনারা নিন পূজার নৈবেদ্য। দেবতার উদ্দেশে আসে নৈবেদ্য, কিন্তু দেবতা থাকেন নিরাসক্ত।”

 অধ্যাপক এই আলোচনার মূল লক্ষ্য কিছুই বুঝলেন না। সগর্বে বললেন, “দিদির মুখে গভীর সত্য কেমন বিনা চেষ্টায় প্রকাশ পায়, বাইরের লোকে শুনলে মনে করবে—"

 তাঁর কেবলই ভয়, বাইরের লোক তাঁর নাতনিকে ঠিক বুঝতে পারবে না।

 অচিরা বললে, “বাইরের লোকে মেয়েদের জ্যাঠামি সইতে পারে না, তাদের কথা তুমি ভেবো না। তুমি আমাকে ঠিক বুঝলেই হল।”

 অচিরা খুব বড়ো কথাও বলে থাকে হাসির ছলে, কিন্তু আজ সে কী গম্ভীর। আমার একটা কথা আন্দাজে মনে হল, ভবতোষ ওকে বুঝিয়েছিল যে, সে যে ভারতসরকারের উচ্চ গগনের জ্যোতির্লোক থেকে বধূ এনেছে, তারও লক্ষ্য খুব উচ্চ এবং নিঃস্বার্থ। ব্রিটিশ রাষ্ট্রশাসনের ভাণ্ডার হতেই সে শক্তি সংগ্রহ করতে পারবে দেশের কাজে লাগাতে। এত সহজ নয় অচিরাকে ছলনা করা। সে যে ভোলে নি, তার প্রমাণ রয়ে গেছে সেই দ্বিখণ্ডিত চিঠির খামটা থেকেই।

 অচিরা আবার বললে, “দেবযানী কচকে কী অভিসম্পাত দিয়েছিল জানেন নবীনবাবু?”

 “না।”

 “বলেছিল, ‘তোমার জ্ঞানসাধনার ধন তুমি নিজে ব্যবহার করতে পারবে না, অন্যকে দান করতে পারবে।’ আমার কাছে কথাটা আশ্চর্য বোধ হয়। যদি এই অভিসম্পাত আজ দিত কেউ য়ুরোপকে, তা হলে সে বেঁচে যেত। বিশ্বের জিনিসকে নিজের জিনিসের মতো ব্যবহার করেই ওরা লোভের তাড়ায় মরছে। সত্যি কি না বলো দাদু।”

 “খুব সত্যি। কিন্তু আশ্চর্য এই এত কথা তুমি কী করে ভাবলে।”

 “নিজগুণে একটুও নয়। ঠিক এই রকম কথা তোমার কাছে অনেকবার শুনেছি। তোমার একটা মহদ্‌গুণ আছে, ভোলানাথ তুমি, কখন্ কী বল সমস্ত ভুলে যাও। চোরাই মালের উপর নিজের ছাপ লাগিয়ে দিতে ভয় থাকে না।”

 আমি বললুম, “চুরিবিদ্যা বড়ো বিদ্যা। বিদ্যায় বলো, রাষ্ট্রেই বলো, বড়ো বড়ো