আগে ক্লাসে যাবার সময়ে মেয়েরা খোঁপায় দুটো ফুল গুঁজে যেত, বেশভূষার কিছু-না-কিছু বাহার করত। এখন তা নিয়ে এদের সংঘে ধিক্ ধিক্ রব ওঠে। পুরুষের মন ভোলাবার জন্যে মেয়েরা সাজবে, গয়না পরবে, এ অপমান মেয়েরা অনেকদিন ইচ্ছে করে মেনে নিয়েছে, কিন্তু আর চলবে না। পরনে বেরঙা খদ্দর চলিত হল। সুরীতি তার গয়নাগুলো দিদিমাকে দিয়ে বললে—‘এগুলো তোমার দান-খয়রাতে লাগিয়ে দিয়ো, আমার দরকার নেই, তোমার পুণ্যি হবে।’ বিধাতা যাকে যে রকম রূপ দিয়েছেন তার উপরে রঙ চড়ানো অসভ্যতা। এ-সমস্ত মধ্য আফ্রিকায় শোভা পায়। মেয়েরা যদি তাকে বলত—‘দেখ্ সুরীতি, অত বাড়াবাড়ি করিস নে। রবি ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদা পড়েছিস তো? চিত্রাঙ্গদা লড়াই করতে জানত, কিন্তু পুরুষের মন ভোলাবার বিদ্যে তার জানা ছিল না, সেখানেই তার হার হল।’ শুনে সুরীতি জ্বলে উঠত, বলত—‘ও আমি মানি নে। এমন অপমানের কথা আর হতে পারে না।’
এদের মধ্যে কোনো কোনো মেয়ের আত্মবিদ্রোহ দেখা দিল। তারা বলতে লাগল, মেয়ে-পুরুষের এই রকম ঘেঁষাঘেষি তফাত করে দেওয়া এখনকার কালের উলটো চাল। বিরুদ্ধবাদিনীরা বলত, ‘পুরুষেরা যে বিশেষ করে আমাদের সমাদর করবে, আমাদের চৌকি এগিয়ে দেবে, আমাদের রুমাল কুড়িয়ে দেবে, এই তো যা হওয়া উচিত। সুরীতি তাকে অপমান বলবে কেন। আমরা তো বলি এই আমাদের সম্মান। পুরুষদের কাছ থেকে আমাদের সেবা আদায় করা চাই। একদিন ছিল যখন মেয়েরা ছিল সেবিকা, দাসী। এখন পুরষেরা এসে মেয়েদের স্তবস্তুতি করে—এই সমাদর, সুরীতি যাই বলুক, আমরা ছাড়তে পারব না। এখন পুরুষ আমাদের দাস।’
এই রকম গোলমাল ভিতরে ভিতরে জেগে উঠল সকলের মধ্যে। বিশেষ করে সলিলার এই নীরস ক্লাসের রীতি ভালো লাগত না। সে ধনী ঘরের মেয়ে, বিরক্ত হয়ে চলে গেল দার্জীলঙে ইংরেজি কলেজে। এমনি করে দুটো-একাটি মেয়ে খসে যেতেও শুরু করেছিল, কিন্তু সুরীতির মন কিছুতেই টলল না।
মেয়েদের মধ্যে, বিশেষত সুরীতির, এই গুমর ছেলেদের অসহ্য হয়ে উঠল। তারা নানা রকম করে ওর উপরে উৎপাত শুরু করলে। গণিতের মাস্টার ছিলেন খুব কড়া। তিনি কোনো রকম ছ্যাবলামি সহ্য করতেন না। তাঁরই ক্লাসে একাদিন মহা গোলমাল বেধে গেল। সুরীতির ডেস্কে তার বাপের হাতের অক্ষরে লেখা লেফাফা—খুলবামাত্রই তার মধ্য থেকে একটা আরসোলা ফর্ফর্ করে বেরিয়ে এল। মহা চেঁচামেচি বেধে গেল। সে জন্তুটা ভয় পেয়ে পাশের মেয়ের খোঁপার উপরে আশ্রয় নিলে। সে এক বিষম হাঁউমাউ কাণ্ড। গণিতের মাস্টার বেণীবাবু খুব কড়া কটাক্ষপাত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু আর্সোলার ফর্ফরানির উপরে তাঁর শাসন খাটবে কী করে। সেই চেঁচামেচিতে ক্লাসের মান-রক্ষা আর হয় না। আর-একদিন—সুরীতির নোট বইয়ের পাতায় পাতায় ছেলেরা নস্যি দিয়েছে ভরে, খুব কড়া নস্যি। বইটা খুলতেই ঘোরতর হাঁচির ছোঁয়াচে উৎপাত বেধে গেল। সে গুঁড়ো পাশের মেয়েদের নাকে ঢুকে পড়ল। সকলকে নাকের জলে চোখের জলে করে দিলে। আর ঘন ঘন হ্যাঁচ্চো শব্দে পড়াশুনা বন্ধ হয় আর-কি। মাস্টার