পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৯৮

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
প্রগতিসংহার
৮৬৯

আড়চোখে দেখেন—দেখে তাঁরও হাসি চাপা শক্ত হয়ে ওঠে।

 একদিন রব উঠল কোনো মহারাজা কলেজ দেখতে আসবেন, বিশেষ করে মেয়েদের ক্লাস। কানে কানে গুজব রটল—তাঁর এই দেখতে আসার লক্ষ্য ছিল বধূ জোগাড় করা। একদল মেয়ে ভান করলে যে, তাদের যেন অপমান করা হচ্ছে। কিন্তু ওরই ভিতরে দেখা গেল সেদিনকার খোঁপায় কিছু শিল্পকাজ, সেদিনকার পাড়ে কিছু রঙ। লোকটি তো যে সে নয়, সে ক্রোড়পতি। মেয়েদের মনের মধ্যে একটা হুড়োমুড়ি ছিল সকলের আগে তাঁর চোখে পড়বার। তার পরে ক্লাস তো হয়ে গেল। একটা দূত এসে জানালে যে তাঁর পছন্দ ঐ সুরীতিকেই। সুরীতি জানে, এ রাজার তহবিলে অগাধ টাকার জোরে পুরুষ জাতির সমস্ত নীচতা কোথায় তলিয়ে যায়। ভান করলে এ প্রস্তাবে সে যে কেবল রাজি নয় তা নয়, বরঞ্চ সে অপমানিত বোধ করছে। কেননা, মেয়েদের ক্লাস তো গোহাটা নয়, যে, ব্যবসায়ী এসে গোরু বাছাই করে নিয়ে যাবে। কিন্তু মনে-মনে ছিল আর-একটু সাধ্যসাধনার প্রত্যাশা। ঠিক এমন সময়ে খবর পাওয়া গেল, মহারাজা তাঁর সমস্ত পাগড়ি-টাগড়ি-সমেত অন্তর্ধান করেছেন। তিনি বলে গিয়েছেন, বাঙালি মেয়েদের মধ্যে একটাকেও বাছাই করে নেবার যোগ্য তিনি দেখলেন না। এর চেয়ে তাঁদের পশ্চিমের বেদের মেয়েরাও অনেক ভালো।

 ক্লাস-সুদ্ধ মেয়েরা একেবারে জ্বলে উঠল। বললে, কে বলেছিল তাঁকে আমাদের এই অপমান করতে আসতে! সেদিন তাদের সাজসজ্জার মধ্যে যে একটু কারিগরি দেখা গিয়েছিল সেটা লজ্জা দিতে লাগল। এমন সময়ে প্রকাশ পেল—মহারাজটি তাদেরই একজন পুরোনো ছাত্র। বাপ-মায়ের বিষয়-সম্পত্তি জুয়ো খেলে উড়িয়ে দিয়ে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে টাকাওয়ালা মেয়ে। মেয়েদের মাথা হেঁট হয়ে গেল। সুরীতি বার বার করে বলতে লাগল— সে একটুও বিশ্বাস করে নি। সে প্রথম থেকেই কেবল যে বিশ্বাস করে নি তা নয়, সে কলেজের প্রিন্সিপাল্‌কে এই পড়ার ব্যাঘাত নিয়ে নালিশ করতে পর্যন্ত তৈরি ছিল। হয়তো ছিল, কিন্তু তার তো কোনো দলিল পাওয়া গেল না।

 এমনি করে একটার পর আর-একটা উৎপাত চলতেই লাগল। এই সমস্ত উপদ্রবের প্রধান পাণ্ডা ছিল নীহার।

 একবার ডিগ্রি নিতে যাচ্ছিল যখন সুরীতি, তার পাশে এসে নীহার বললে, “কী গো গরবিনী, মাটিতে যে পা পড়ছে না!”

 সুরীতি মখ বেঁকিয়ে বললে, “দেখুন, আপনি আমার নাম নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।”

 নীহার বললে, “তুমি বিদুষী হয়ে একে ঠাট্টা বলো, এ যে বিশুদ্ধ ক্লাসিক্যাল সাহিত্য থেকে কোটেশন করা! এমন সম্মান কি আর কোনো নামে হতে পারে!”

 “আমাকে আপনার সম্মান করতে হবে না।”

 “সম্মান না করে বাঁচি কী করে! হে বিকচকমলায়তলোচনা, হে পরিণতশরচ্চন্দ্রবদনা, হে স্মিতহাস্যজ্যোৎস্নাবিকাশিনী, তোমাকে আদরের নামে ডেকে যে তৃপ্তির শেষ হয় না।”

 “দেখুন, আপনি আমাকে রাস্তার মধ্যে যদি এরকম অপমান করেন, আমি