পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬১৮
গল্পগুচ্ছ

এই সময়ে থানাগড়ের বাবুদের এক ছেলে এক বাইসিকল কিনিয়া আনিয়া চড়া অভ্যাস করিতেছিল। রসিক সেটাকে লইয়া অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই এমন আয়ত্ত করিয়া লইল যেন সে তাহার নিজেরই পায়ের তলাকার একটা ডানা। কিন্তু, কী চমৎকার, কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ! দূরত্বের সমস্ত বাধাকে এই বাহনটা যেন তীক্ষ্ণ সুদর্শনচক্রের মতো অতি অনায়াসেই কাটিয়া দিয়া চলিয়া যায়। ঝড়ের বাতাস যেন চাকার আকার ধারণ করিয়া উন্মত্তের মতো মানুষকে পিঠে করিয়া লইয়া ছোটে। রামায়ণ-মহাভারতের সময় মানুষে কখনো কখনো দেবতার অস্ত্র লইয়া যেমন ব্যবহার করিতে পাইত এ যেন সেইরকম।
 রসিকের মনে হইল, এই বাইসিকল নহিলে তাহার জীবন বৃথা। দাম এমনই কী বেশি। এক-শো পঁচিশ টাকা মাত্র! এই এক-শো পঁচিশ টাকা দিয়া মানুষ একটা নূতন শক্তি লাভ করিতে পারে—ইহা তো সস্তা। বিষ্ণুর গরুড়বাহন এবং সূর্যের অরুণসারথি তো সৃষ্টিকর্তাকে কম ভোগ ভোগায় নাই, আর ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবার জন্য সমুদ্রমন্থন করিতে হইয়াছিল—কিন্তু এই বাইসিকলটি তাহার পৃথিবীজয়ী গতি-বেগ স্তব্ধ করিয়া কেবল এক-শো পঁচিশ টাকার জন্য দোকানের এক কোণে দেয়াল ঠেস দিয়া প্রতীক্ষা করিয়া আছে।
 দাদার কাছে রসিক আর-কিছু চাহিবে না পণ করিয়াছিল, কিন্তু সে পণ রক্ষা হইল না। তবে চাওয়াটার কিছু বেশ পরিবর্তন করিয়া দিল। কহিল, “আমাকে এক-শো পঁচিশ টাকা ধার দিতে হইবে।”
 বংশীর কাছে রসিক কিছুদিন হইতে কোনো আবদার করে নাই, ইহাতে শরীরের অসুখের উপর আর-একটা গভীরতর বেদনা বংশীকে দিনরাত্রি পীড়া দিতেছিল। তাই রসিক তাহার কাছে দরবার উপস্থিত করিবামাত্রই মুহূর্তের জন্য বংশীর মন নাচিয়া উঠিল; মনে হইল, ‘দূর হোকগে ছাই, এমন করিয়া আর টানা-টানি করা যায় না—দিয়া ফেলি।’ কিন্তু বংশ? সে যে একেবারেই ডোবে! এক-শো পঁচিশ টাকা দিলে আর বাকি থাকে কী। ধার! রসিক এক-শো পঁচিশ টাকা ধার শুধিবে! তাই যদি সম্ভব হইত তবে তো বংশী নিশ্চিন্ত হইয়া মরিতে পারিত।
 বংশী মনটাকে একেবারে পাথরের মতো শক্ত করিয়া বলিল, “সে কি হয়। এক-শো পঁচিশ টাকা আমি কোথায় পাইব।”
 রসিক বন্ধুদের কাছে বলিল, “এ টাকা যদি না পাই তবে আমি বিবাহ করিবই না।”
 বংশীর কানে যখন সে কথা গেল তখন সে বলিল, “এও তো মজা মন্দ নয়। পাত্রীকে টাকা দিতে হইবে, আবার পাত্রকে না দিলেও চলিবে না। এমন দায় তো আমাদের সাত পুরুষের মধ্যে কখনো ঘটে নাই।”
 রসিক সুস্পষ্ট বিদ্রোহ করিয়া তাঁতের কাজ হইতে অবসর লইল। জিজ্ঞাসা করিলে বলে, “আমার অসুখ করিয়াছে।” তাঁতের কাজ না করা ছাড়া তাহার আহার-বিহারে অসুখের অন্য কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাইল না। বংশী মনে মনে একটু অভিমান করিয়া বলিল, “থাক্, উহাকে আমি আর কখনো কাজ করিতে বলিব না।”