পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৩৮
গল্পগুচ্ছ

 অদ্ভুত বটে! এ বংশে কতকাল ধরিয়া কত বড়ােবাবু জন্মিয়াছে এবং কোনােদিন নীলকণ্ঠেরও অভাব নাই। নীলকণ্ঠেরা বিষয়ব্যবস্থার সমস্ত দায় নিজেরা লইয়াছে আর বড়ােবাবুরা সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্টভাবে বংশগৌরব রক্ষা করিয়াছে। এমন বিপরীত ব্যাপার তাে কোনােদিন ঘটে নাই!

 আজ এই পরিবারের বড়ােবাবুর পদের অবনতি ঘটাতে বড়ােবউয়ের সম্মানে আঘাত লাগিল। ইহাতে এতদিন পরে আজ স্বামীর প্রতি কিরণের যথার্থ অশ্রদ্ধার কারণ ঘটিল। এতদিন পরে তাহার বসন্তকালের লট্‌কানে রঙের শাড়ি এবং খোঁপার বেলফুলের মালা লজ্জায় ম্লান হইয়া গেল।

 কিরণের বয়স হইয়াছে অথচ সন্তান হয় নাই। এই নীলকণ্ঠই একদিন কর্তার মত করাইয়া পাত্রী দেখিয়া বনােয়ারির আর-একটি বিবাহ প্রায় পাকাপাকি স্থির করিয়াছিল। বনােয়ারি হালদারবংশের বড়াে ছেলে, সকল কথার আগে এ কথা তাে মনে রাখিতে হইবে। সে অপুত্রক থাকিবে, ইহা তাে হইতেই পারে না। এই ব্যাপারে কিরণের বুক দুর্‌দুর্‌ করিয়া কাঁপিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু, ইহা সে মনে মনে না স্বীকার করিয়া থাকিতে পারে নাই যে, কথাটা সংগত। তখনাে সে নীলকণ্ঠের উপরে কিছুমাত্র রাগ করে নাই, সে নিজের ভাগ্যকেই দোষ দিয়াছে। তাহার স্বামী যদি নীলকণ্ঠকে রাগিয়া মারিতে না যাইত এবং বিবাহসম্বন্ধ ভাঙিয়া দিয়া পিতামাতার সঙ্গে রাগারাগি না করিত তবে কিরণ সেটাকে অন্যায় মনে করিত না। এমন-কি, বনােয়ারি যে তাহার বংশের কথা ভাবিল না, ইহাতে অতি গােপনে কিরণের মনে বনােয়ারির পৌরুষের প্রতি একটু অশ্রদ্ধাই হইয়াছিল। বড়াে ঘরের দাবি কি সামান্য দাবি। তাহার যে নিষ্ঠুর হইবার অধিকার আছে। তাহার কাছে কোনাে তরুণী স্ত্রীর কিম্বা কোনাে দুঃখী কৈবর্তের সুখদুঃখের কতটুকুই বা মুল্য!

 সাধারণত যাহা ঘটিয়া থাকে এক-একবার তাহা না ঘটিলে কেহই তাহা ক্ষমা করিতে পারে না, এ কথা বনােয়ারি কিছুতেই বুঝিতে পারিল না। সম্পূর্ণরূপে এ বাড়ির বড়ােবাবু হওয়াই তাহার উচিত ছিল; অন্য কোনাে প্রকারের উচিত-অনুচিত চিন্তা করিয়া এখানকার ধারাবাহিকতা নষ্ট করা যে তাহার অকর্তব্য, তাহা সে ছাড়া সকলেরই কাছে অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

 এ লইয়া কিরণ তাহার দেবরের কাছে কত দুঃখই করিয়াছে। বংশী বুদ্ধিমান; তাহার খাওয়া হজম হয় না এবং একটু হাওয়া লাগিলেই সে হাঁচিয়া কাশিয়া অস্থির হইয়া উঠে, কিন্তু সে স্থির ধীর বিচক্ষণ। সে তাহার আইনের বইয়ের যে অধ্যায়টি পড়িতেছিল সেইটেকে টেবিলের উপর খােলা অবস্থায় উপুড় করিয়া রাখিয়া কিরণকে বলিল, “এ পাগলামি ছাড়া আর-কিছুই নহে।” কিরণ অত্যন্ত উদ্‌বেগের সহিত মাথা নাড়িয়া কহিল, “জান তাে ঠাকুরপো, তােমার দাদা যখন ভালাে আছেন তখন বেশ আছেন, কিন্তু একবার যদি খ্যাপেন তবে তাঁহাকে কেহ সামলাইতে পারে না। আমি কী করি বলো তাে।”

 পরিবারের সকল প্রকৃতিস্থ লােকের সঙ্গেই যখন কিরণের মতের সম্পূর্ণ মিল হইল তখন সেইটেই বনােয়ারির বুকে সকলের চেয়ে বাজিল। এই একটুখানি স্ত্রীলােক, অনতিস্ফুট চাঁপাফুলটির মতাে পেলব, ইহার হৃদয়টিকে আপন বেদনার কাছে টানিয়া আনিতে পুরুষের সমস্ত শক্তি পরাস্ত হইল। আজকের দিনে কিরণ