পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বােষ্টমী
৬৬১

বাঁচিয়া আছেন। মেয়েকে যে বহুলােক ভক্তি করিয়া থাকে সে খবর তিনি জানেন। তাঁহার ইচ্ছা, মেয়ে তাঁর কাছে গিয়া থাকে, কিন্তু আনন্দীর মন তাহাতে সায় দেয় না।

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তােমার চলে কী করিয়া।”

 উত্তরে শুনিলাম, তাহার ভক্তদের একজন তাহাকে সামান্য কিছু জমি দিয়াছে। তাহারই ফসলে সেও খায়, পাঁচজনে খায়, কিছুতে সে আর শেষ হয় না। বলিয়া একট, হাসিয়া কহিল, “আমার তাে সবই ছিল—সমস্ত ছাড়িয়া আসিয়াছি, আবার পরের কাছে মাগিয়া সংগ্রহ করিতেছি, ইহার কী দরকার ছিল বলাে তাে।”

 শহরে থাকিতে এ প্রশ্ন উঠিলে সহজে ছাড়িতাম না। ভিক্ষাজীবিতায় সমাজের কত অনিষ্ট তাহা বুঝাইতাম। কিন্তু, এ জায়গায় আসিলে আমার পুঁথিপড়া বিদ্যার সমস্ত ঝাঁজ একেবারে মরিয়া যায়। বােষ্টমীর কাছে কোনাে তর্কই আমার মুখ দিয়া বাহির হইতে চাহিল না; আমি চুপ করিয়া রহিলাম।

 আমার উত্তরের অপেক্ষা না রাখিয়া সে আপনিই বলিয়া উঠিল, “না না, এই আমার ভালাে। আমার মাগিয়া খাওয়া অন্নই অমৃত।”

 তাহার কথার ভাবখানা আমি বুঝিলাম। প্রতিদিনই যিনি নিজে অন্ন জোগাইয়া দেন ভিক্ষার অন্নে তাঁহাকেই মনে পড়ে। আর, ঘরে মনে হয়, আমারই অন্ন আমি নিজের শক্তিতে ভােগ করিতেছি।

 ইচ্ছা ছিল, তাহার স্বামীর ঘরের কথা জিজ্ঞাসা করি, কিন্তু সে নিজে বলিল না, আমিও প্রশ্ন করিলাম না।

 এখানকার যে পাড়ায় উচ্চবর্ণের ভদ্রলােকে থাকে সে পাড়ার প্রতি বােষ্টমীর শ্রদ্ধা নাই। বলে, ঠাকুরকে উহারা কিছুই দেয় না, অথচ ঠাকুরের ভােগে উহারাই সব চেয়ে বেশি করিয়া ভাগ বসায়। গরিবরা ভক্তি করে আর উপবাস করিয়া মরে।

 এ পাড়ার দুষ্কৃতির কথা অনেক শুনিয়াছি, তাই বলিলাম, “এই-সকল দুর্মতিদের মাঝখানে থাকিয়া ইহাদের মতিগতি ভালাে করাে, তাহা হইলেই তাে ভগবানের সেবা হইবে।”

 এই রকমের সব উঁচু দরের উপদেশ অনেক শুনিয়াছি এবং অন্যকে শূনাইতেও ভালােবাসি। কিন্তু, বােষ্টমীর ইহাতে তাক্ লাগিল না। আমার মুখের দিকে তাহার উজ্জ্বল চক্ষুদুটি রাখিয়া সে বলিল, “তুমি বলিতেছ, ভগবান পাপীর মধ্যেও আছেন, তাই উহাদের সঙ্গ করিলেও তাঁহারই পূজা করা হয়। এই তাে?”

 আমি কহিলাম, “হাঁ।”

 সে বলিল, “উহারা যখন বাঁচিয়া আছে তখন তিনিও উহাদের সঙ্গে আছেন বই-কি। কিন্তু, আমার তাহাতে কী। আমার তাে পুজা ওখানে চলিবে না; আমার ভগবান যে উহাদের মধ্যে নাই। তিনি যেখানে আমি সেখানেই তাঁহাকে খুঁজিয়া বেড়াই।”

 বলিয়া সে আমাকে প্রণাম করিল। তাহার কথাটা এই যে, শুধু মত লইয়া কী হইবে, সত্য যে চাই। ভগবান সর্বব্যাপী, এটা একটা কথা—কিন্তু যেখানে আমি তাঁহাকে দেখি সেখানেই তিনি আমার সত্য।

 এত বড়াে বাহুল্য কথাটাও কোনাে কোনাে লােকের কাছে বলা আবশাক যে, আমাকে উপলক্ষ করিয়া বােষ্টমী যে ভক্তি করে আমি তাহা গ্রহণও করি না, ফিরাইয়াও