পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৯৮
গল্পগুচ্ছ

আপনার রােগক্লান্ত হাতটি রাখিল।

 একবার নিশ্বাস ফেলিয়া, একটুখানি উসখুস করিয়া যতীন বলিল, “মাসি, মণি যদি জেগেই থাকে তা হলে একবার যদি তাকে—”

 “এখনি ডেকে দিচ্ছি, বাবা।”

 “আমি বেশি ক্ষণ তাকে এ ঘরে রাখতে চাই নে—কেবল পাঁচ মিনিট—দুটো-একটা কথা যা বলবার আছে—”


মাসি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মণিকে ডাকিতে আসিলেন। এ দিকে যতীনের নাড়ী দ্রুত চলিতে লাগিল। যতীন জানে, আজ পর্যন্ত সে মণির সঙ্গে ভালাে করিয়া কথা জমাইতে পারে নাই। দুই যন্ত্র দুই সুরে বাঁধা, এক সঙ্গে আলাপ চলা বড়াে কঠিন। মণি তাহার সঙ্গিনীদের সঙ্গে অনর্গল বকিতেছে হাসিতেছে, দুর হইতে তাহাই শুনিয়া যতীনের মন কতবার ঈর্ষায় পীড়িত হইয়াছে। যতীন নিজেকেই দোষ দিয়াছে—সে কেন অমন সামান্য যাহা-তাহা লইয়া কথা কহিতে পারে না। পারে না যে তাহাও তাে নহে, নিজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যতীন সামান্য বিষয় লইয়াই কি আলাপ করে না। কিন্তু, পুরুষের যাহা-তাহা তাে মেয়েদের যাহা-তাহার সঙ্গে ঠিক মেলে না। বড়াে কথা একলাই একটানা বলিয়া যাওয়া চলে, অন্য পক্ষ মন দিল কি না খেয়াল না করিলেই হয়; কিন্তু তুচ্ছ কথায় নিয়ত দুই পক্ষের যােগ থাকা চাই। বাঁশি একাই বাজিতে পারে, কিন্তু দুইয়ের মিল না থাকিলে করতালের খচমচ জমে না। এইজন্য কত সন্ধ্যাবেলায় যতীন মণির সঙ্গে যখন খোলা বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে, দুটো-চারটে টানাবােনা কথার পরেই কথার সূত্র একেবারে ছিঁড়িয়া ফাঁক হইয়া গেছে; তাহার পরে সন্ধ্যার নীরবতা যেন লজ্জায় মরিতে চাহিয়াছে। যতীন বুঝিতে পারিয়াছে, মণি পালাইতে পারিলে বাঁচে; মনে মনে কামনা করিয়াছে, এখনই কোনাে-একজন তৃতীয় ব্যক্তি যেন আসিয়া পড়ে। কেননা, দুই জনে কথা কহা কঠিন, তিন জনে সহজ।

 মণি আসিলে আজ কেমন করিয়া কথা আরম্ভ করিবে যতীন তাহাই ভাবিতে লাগিল। ভাবিতে গেলে কথাগুলাে কেমন অস্বাভাবিক-রকম বড়াে হইয়া পড়ে— সে-সব কথা চলিবে না। যতীনের আশঙ্কা হইতে লাগিল আজকের রাত্রের পাঁচ মিনিটও ব্যর্থ হইবে। অথচ, তাহার জীবনের এমনতরাে নিরালা পাঁচ মিনিট আর কটাই বা বাকি আছে।

 “একি বউ, কোথাও যাচ্ছ নাকি।”

 “সীতারামপুরে যাব।”

 “সে কী কথা। কার সঙ্গে যাবে।”

 “অনাথ নিয়ে যাচ্ছে।”

 “লক্ষ্মী মা আমার, তুমি যেয়াে, আমি তােমাকে বারণ করব না—কিন্তু আজ নয়।”