পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শেষের রাত্রি
৭০১

 "মণি তােমাকে ভিতরে ভিতরে খুব—”

 “সে কি জানি নে যতীন। তুই এখন ঘুমাে।”

 “আমি মণিকে সব লিখে দিলুম বটে, কিন্তু তােমারই সব রইল মাসি। ও তাে তোমাকে কখনাে অমান্য করবে না।”

 “সেজন্য অত ভাবছ কেন, বাছা।”

 “তােমার আশীর্বাদেই আমার সব, তুমি আমার উইল দেখে এমন কথা কোনােদিন মনে কোরাে না—”

 “ও কী কথা যতীন। তােমার জিনিস তুমি মণিকে দিয়েছ বলে আমি মনে করব! আমার এমনি পােড়া মন! তােমার জিনিস ওর নামে লিখে দিয়ে যেতে পারছ বলে তােমার যে সুখ সেই তাে আমার সকল সুখের বেশি, বাপ।”

 “কিন্তু, তােমাকেও আমি—”

 “দেখ্ যতীন, এইবার আমি রাগ করব। তুই চলে যাবি, আর তুই আমাকে টাকা দিয়ে ভুলিয়ে রেখে যাবি?”

 “মাসি, টাকার চেয়ে আরও বড়াে যদি কিছু, তােমাকে—”

 “দিয়েছিস যতীন, ঢের দিয়েছিস। আমার শূন্য ঘর ভরে ছিলি, এ আমার অনেক জন্মের ভাগ্য। এতদিন তাে বুক ভরে পেয়েছি, আজ আমার পাওনা যদি ফুরিয়ে গিয়ে থাকে তাে নালিশ করব না। দাও, সব লিখে দাও, লিখে দাও—বাড়িঘর, জিনিসপত্র, ঘােড়াগাড়ি, তালক-মুলক —যা আছে সব মণির নামে লিখে দাও—এ-সব বােঝা আমার সইবে না।”

 “তােমার ভােগে রুচি নেই—কিন্তু, মণির বয়স অল্প, তাই—”

 “ও কথা বলিস নে, ও কথা বলিস নে। ধনসম্পদ দিতে চাস দে, কিন্তু ভােগ করা—”

 “কেন ভােগ করবে না মাসি।”

 “না গাে না, পারবে না, পারবে না! আমি বলছি, ওর মুখে রুচবে না! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে, কিছুতে কোনাে রস পাবে না।”

 যতীন চুপ করিয়া রহিল। তাহার অভাবে সংসারটা মণির কাছে একেবারে বিস্বাদ হইয়া যাইবে এ কথা সত্য কি মিথ্যা, সুখের কি দুঃখের, তাহা সে যেন ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিল না। আকাশের তারা যেন তাহার হদয়ের মধ্যে আসিয়া কানে কানে বলিল, ‘এমনিই বটে—আমরা তাে হাজার হাজার বছর হইতে দেখিয়া আসিলাম, সংসার-জোড়া এই-সমস্ত আয়ােজন এত বড়ােই ফাঁকি।’

 যতীন গভীর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “দেবার মতাে জিনিস তাে আমরা কিছুই দিয়ে যেতে পারি নে।”

 “কম কী দিয়ে যাচ্ছ বাছা। এই ঘরবাড়ি-টাকাকড়ির ছল করে তুমি ওকে যে কী দিয়ে গেলে তার মূল্য ও কি কোনােদিন বুঝবে না। যা তুমি দিয়েছ তাই মাথা পেতে নেবার শক্তি বিধাতা ওকে দিন, এই আশীর্বাদ ওকে করি।”

 “আর-একটু বেদানার রস দাও, আমার গলা শুকিয়ে এসেছে। মণি কি কাল এসেছিল—আমার ঠিক মনে পড়ছে না।”

 “এসেছিল। তখন তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। শিয়রের কাছে বসে বসে অনেক ক্ষণ