পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
তপস্বিনী
৭২১

কিছুই শক্ত নয়, কিন্তু লােকের কাছে এই অপমানের সে কী কৈফিয়ত দিবে।

 অবশেষে অনেক চিন্তার পর একদিন ভােরবেলায় তার মাথায় আসিল, এ সংসারে মৃত্যু ছাড়া আর-একটা পথ খােলা আছে যেটা বি.এ. পাসের অধীন নয় এবং যেটাতে দারা সুত ধন জন সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। সে আর কিছু নয়, সন্ন্যাসী হওয়া। এই চিন্তাটার উপর কিছুদিন ধরিয়া গােপনে সে বিস্তর সিগারেটের ধোঁয়া লাগাইল, তার পর একদিন দেখা গেল স্কুলঘরে মেঝের উপর তার কী-বইয়ের ছেঁড়া টুকরােগুলাে পরীক্ষাদুর্গের ভগ্নাবশেষের মতাে ছড়ানাে পড়িয়া আছে—পরীক্ষার্থীর দেখা নাই। টেবিলের উপর এক-টুকরা কাগজ ভাঙা কাঁচের গেলাস দিয়া চাপা, তাহাতে লেখা—

‘আমি সন্ন্যাসী—আমার আর গাড়ির দরকার হইবে না।

শ্রীযুক্ত বরদানন্দস্বামী।’

 মাখনবাবু কিছুদিন কোনাে খোঁজই করিলেন না। তিনি ভাবিলেন, বরদাকে নিজের গরজেই ফিরিতে হইবে, খাঁচার দরজা খােলা রাখা ছাড়া আর-কোনাে আয়ােজনের দরকার নাই। দরজা খােলাই রহিল, কেবল সেই কী-বইগুলোর ছেঁড়া টুকরা সাফ হইয়া গেছে—আর-সমস্ত ঠিক আছে। ঘরের কোণে সেই জলের কুঁজার উপরে কানা-ভাঙা গেলাসটা উপুড় করা; তেলের-দাগে-মলিন চৌকিটার আসনের জায়গায় ছারপােকার উৎপাত ও জীর্ণতার ত্রুটি-মােচনের জন্য একটা পুরাতন অ্যাট্‌লাসের মলাট পাতা; এক ধারে একটা শূন্য প্যাক্‌বাক্সের উপর একটা টিনের তােরঙ্গে বরদার নাম আঁকা; দেয়ালের গায়ে তাকের উপর একটা মলাট-ছেঁড়া ইংরেজি-বাংলা ডিক্সনারি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভারতবর্ষের ইতিহাসের কতকগুলা পাতা, এবং মলাটে রানী ভিক্টোরিয়ার মুখ-আঁকা অনেকগুলাে এক্সেসাইজ বই। এই খাতা ঝাড়িয়া দেখিলে ইহার অধিকাংশ হইতে অগ্‌ডেন কোম্পানির সিগারেট-বাক্স-বাহিনী বিলাতি নটীদের মূর্তি ঝরিয়া পড়িবে। সন্ন্যাস-আশ্রয়ের সময় পথের সান্ত্বনার জন্য এগুলাে যে বরদা সঙ্গে লয় নাই তাহা হইতে বুঝা যাইবে তার মন প্রকৃতিস্থ ছিল না।


আমাদের নায়কের তাে এই দশা; নায়িকা ষোড়শী তখন সবেমাত্র ত্রয়ােদশী। বাড়িতে শেষ পর্যন্ত সবাই তাকে খুকি বলিয়া ডাকিত, শ্বশুরবাড়িতেও সে আপনার এই চিরশৈশবের খ্যাতি লইয়া আসিয়াছিল, এইজন্য তার সামনেই বরদার চরিত্র-সমালােচনায় বাড়ির দাসীগুলাের পর্যন্ত বাধিত না। শাশুড়ি ছিলেন চিররুগ্‌ণা—কর্তার কোনাে বিধানের উপরে কোনাে কথা বলিবার শক্তি তাঁর ছিল না, এমন-কি, মনে করিতেও তাঁর ভয় করিত। পিস্‌শাশুড়ির ভাষা ছিল খুব প্রখর; বরদাকে লইয়া তিনি খুব শক্ত শক্ত কথা খুব চোখা চোখা করিয়া বলিতেন, তার বিশেষ একটু কারণ ছিল। পিতামহদের আমল হইতে কৌলীন্যের অপদেবতার কাছে বংশের মেয়েদের বলি দেওয়া এ বাড়ির একটা প্রথা। এই পিসি যার ভাগে পড়িয়াছিলেন সে একটা প্রচণ্ড গাঁজাখাের। তার গুণের মধ্যে এই যে, সে বেশিদিন বাঁচে নাই। তাই আদর করিয়া ষোড়শীকে তিনি যখন মুক্তাহারের সঙ্গে তুলনা করিতেন তখন অন্তর্যামী বুঝিতেন, ব্যর্থ মুক্তাহারের জন্য যে আক্ষেপ সে একা যােড়শীকে লইয়া নয়।

 এ ক্ষেত্রে মুক্তাহারের যে বেদনাবােধ আছে সে কথা সকলে ভুলিয়াছিল। পিসি