পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
তপস্বিনী
৭২৩

করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘বরদার এত লেখাপড়ার দরকারই বা কী ছিল। টাকার তাে অভাব নাই। যাই বল বাপ, তার শরীরে কিন্তু দোষ ছিল না। আহা, সােনার টুকরাে ছেলে!’ তার স্বামী যে পবিত্রতার আদর্শ ছিল এবং সংসারসুদ্ধ সকলেই তার প্রতি অন্যায় করিয়াছে, সকল দুঃখের মধ্যে এই সান্ত্বনায়, এই গৌরবে ষোড়শীর মন ভরিয়া উঠিতে লাগিল।

 এ দিকে বাপের ব্যথিত হদয়ের সমস্ত স্নেহ দ্বিগুণ করিয়া ষোড়শীর উপর আসিয়া পড়িল। বউমা যাতে সুখে থাকে, মাখনের এই একমাত্র ভাবনা। তাঁর বড়াে ইচ্ছা, ষোড়শী তাকে এমন-কিছু ফরমাশ করে যেটা দুর্লভ—অনেকটা কষ্ট করিয়া, লােকসান করিয়া, তিনি তাকে একটু খুশি করিতে পারিলে যেন বাঁচেন—তিনি এমন করিয়া ত্যাগ স্বীকার করিতে চান যেটা তাঁর পক্ষে প্রায়শ্চিত্তের মতাে হইতে পারে।

যােড়শী পনেরাে বছরে পড়িল। ঘরের মধ্যে একলা বসিয়া যখন-তখন তার চোখ জলে ভরিয়া আসে। চিরপরিচিত সংসারটা তাকে চারি দিকে যেন আঁটিয়া ধরে, তার প্রাণ হাঁপাইয়া ওঠে। তার ঘরের প্রত্যেক জিনিসটা, তার বারান্দার প্রত্যেক রেলিঙটা, আলিসার উপর যে-কয়টা ফুলের গাছের টব চিরকাল ধরিয়া খাড়া দাঁড়াইয়া আছে, তারা সকলেই যেন অন্তরে অন্তরে তাকে বিরক্ত করিতে থাকিত। পদে পদে ঘরের খাটটা, আল্‌নাটা, আলমারিটা—তার জীবনের শূন্যতাকে বিস্তারিত করিয়া ব্যাখ্যা করে; সমস্ত জিনিসপত্রের উপর তার রাগ হইতে থাকে।

 সংসারে তার একমাত্র আরামের জায়গা ছিল ঐ জানালার কাছটা। যে বিশ্বটা তার বাহিরে সেইটেই ছিল তার সব চেয়ে আপন। কেননা, তার ঘর হইল বাহির, বাহির হইল ঘর।

 একদিন যখন বেলা দশটা—অন্তঃপুরে যখন বাটি, বারকোষ, ধামা, চুপড়ি, শিলনােড়া ও পানের বাক্সের ভিড় জমাইয়া ঘরকন্নার বেগ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে—এমন সময় সংসারের সমস্ত ব্যস্ততা হইতে স্বতন্ত্র হইয়া জানলার কাছে ষোড়শী আপনার উদাস মনকে শূন্য আকাশে দিকে দিকে রওনা করিয়া দিতেছিল। হঠাৎ ‘জয় বিশ্বেশ্বর’ বলিয়া হাঁক দিয়া এক সন্ন্যাসী তাহাদের গেটের কাছের অশথতলা হইতে বাহির হইয়া আসিল। ষােড়শীর সমস্ত দেহতন্তু মীড়টানা বীণার তারের মতাে চরম ব্যাকুলতায় বাজিয়া উঠিল। সে ছুটিয়া আসিয়া পিসিকে বলিল, “পিসিমা, ঐ সন্ন্যাসীঠাকুরের ভােগের আয়ােজন করাে।”

 এই শুরু হইল। সন্ন্যাসীর সেবা ষোড়শীর জীবনের লক্ষ্য হইয়া উঠিল। এতদিন পরে শ্বশুরের কাছে বধূর আবদারের পথ খুলিয়াছে। মাখন উৎসাহ দেখাইয়া বলিলেন, বাড়িতে বেশ ভালােরকম একটা অতিথিশালা খােলা চাই। মাখনবাবুর কিছু কাল হইতে আয় কমিতেছিল; কিন্তু, তিনি বারাে টাকা সুদে ধার করিয়া সৎকর্মে লাগিয়া গেলেন।

 সন্ন্যাসীও যথেষ্ট জুটিতে লাগিল। তাদের মধ্যে অধিকাংশ যে খাঁটি নয়, মাখনের সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু, বউমার কাছে তার আভাস দিবার জো কী। বিশেষত