পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৩৮
গল্পগুচ্ছ

বাঁধা দিয়ে তো দেনা শোধ হবে না!

 সুকুমারী। যার সামর্থ্য কম তার অত লম্বা চালেই বা দরকার কী।

 শশধর। মন্মথ তো সেই কথাই বলত। আমরাই তো সতীশকে অন্যরূপ বুঝিয়েছিলেম। এখন ওকে দোষ দিই কী করে।

 সুকুমারী। না-দোষ কি ওর হতে পারে। সব দোষ আমারই। তুমি তো আর কারও কোনো দোষ দেখতে পাও না—কেবল আমার বেলাতেই তোমার দর্শনশক্তি বেড়ে যায়।

 শশধর। ওগো, রাগ কর কেন—আমিও তো দোষী।

 সুকুমারী। তা হতে পারে। তোমার কথা তুমি জান। কিন্তু, আমি কখনো ওকে এমন কথা বলি নি যে, তুমি তোমার মেসোর ঘরে পায়ের উপর পা দিয়ে গোঁফে তা দাও, আর লম্বা কেদারায় বসে বসে আমার বাছার উপর বিষদৃষ্টি দিতে থাকো।

 শশধর। না, ঠিক ঐ কথাগুলো তুমি তাকে মাথার দিব্য দিয়ে শপথ করিয়ে নাও নি—অতএব তোমাকে দোষ দিতে পারি নে। এখন কী করতে হবে বলো।

 সকুমারী। সে তুমি যা ভালো বোধ কর তাই করো। কিন্তু, আমি বলছি, সতীশ যতক্ষণ এ বাড়িতে থাকবে, আমি খোকাকে কোনোমতে বাইরে যেতে দিতে পারব না। ডাক্তার খোকাকে হাওয়া খাওয়াতে বিশেষ করে বলে দিয়েছে—কিন্তু হাওয়া খেতে গিয়ে ও কখন একলা সতীশের নজরে পড়বে, সে কথা মনে করলে আমার মন স্থির থাকে না। ও তো আমারই আপন বোনের ছেলে, কিন্তু আমি ওকে এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করি নে—এ আমি তোমাকে স্পষ্টই বললেম।

সতীশের প্রবেশ

 সতীশ। কাকে বিশ্বাস কর না, মাসিমা। আমাকে? আমি তোমার খোকাকে সুযোেগ পেলে গলা টিপে মারব, এই তোমার ভয়? যদি মারি, তবে তুমি তোমার বোনের ছেলের যে অনিষ্ট করেছ তার চেয়ে ওর কি বেশি অনিষ্ট করা হবে। কে আমাকে ছেলেবেলা হতে নবাবের মতো শৌখিন করে তুলেছে এবং আজ ভিক্ষুকের মতো পথে বের করলে। কে আমাকে পিতার শাসন হতে কেড়ে এনে বিশ্বের লাঞ্ছনার মধ্যে টেনে আনলে। কে আমাকে—

 সুকুমারী। ওগো, শুনছ? তোমার সামনে আমাকে এমনি করে অপমান করে! নিজের মুখে বললে কিনা খোকাকে গলা টিপে মারবে! ওমা, কী হবে গো। আমি কালসাপকে নিজের হাতে দুধকলা দিয়ে পুষেছি।

 সতীশ। দুধকলা আমারও ঘরে ছিল—সে দুধকলায় আমার রক্ত বিষ হয়ে উঠত না—তা হতে চিরকালের মতো বঞ্চিত করে তুমি যে দুধকলা আমাকে খাইয়েছ তাতে আমার বিষ জমে উঠেছে। সত্য কথাই বলছ, এখন আমাকে ভয় করাই চাই—এখন আমি দংশন করতে পারি।

বিধুমুখীর প্রবেশ

 বিধু। কী সতীশ, কী হয়েছে, তোকে দেখে যে ভয় হয়। অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন। আমাকে চিনতে পারছিস নে? আমি যে তোর মা, সতীশ।

 সতীশ। মা, তোমাকে মা বলব কোন মুখে। মা হয়ে কেন তুমি আমার পিতার শাসন হতে আমাকে বঞ্চিত করলে। কেন তুমি আমাকে জেল হতে ফিরিয়ে আনলে।