পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গুপ্তধন
৫৪৯

সন্ন্যাসী চলিয়া গেল। প্রথমটা মৃত্যুঞ্জয়ের মনােযােগ আকৃষ্ট হইল না। একটু পরে হঠাৎ তাহার মনে হইল, যে লােকটা চলিয়া গেল এই তাে সেই সন্ন্যাসী! তাড়াতাড়ি হুঁকাটা রাখিয়া মুদিকে সচকিত করিয়া এক দৌড়ে সে দোকান হইতে বাহির হইয়া গেল। কিন্তু, সে সন্ন্যাসীকে দেখা গেল না।

 তখন সন্ধ্যা অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে। অপরিচিত স্থানে কোথায় যে সন্ন্যাসীর সন্ধান করিতে যাইবে, তাহা সে ঠিক করিতে পারিল না। দোকানে ফিরিয়া আসিয়া মুদিকে জিজ্ঞাসা করিল, “ঐ-যে মস্ত বন দেখা যাইতেছে ওখানে কী আছে।”

 মুদি কহিল, “এককালে ঐ বন শহর ছিল, কিন্তু অগস্ত্য মুনির শাপে ওখানকার রাজা প্রজা সমস্তই মড়কে মরিয়াছে। লােকে বলে, ওখানে অনেক ধনরত্ন আজও খুঁজিলে পাওয়া যায়; কিন্তু দিনদুপরেও ঐ বনে সাহস করিয়া কেহ যাইতে পারে না। যে গেছে সে আর ফেরে নাই।”

 মৃত্যুঞ্জয়ের মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। সমস্ত রাত্রি মুদির দোকানে মাদুরের উপর পড়িয়া মশার জ্বালায় সর্বাঙ্গ চাপড়াইতে লাগিল আর ঐ বনের কথা, সন্ন্যাসীর কথা, সেই হারানাে লিখনের কথা ভাবিতে থাকিল। বার বার পড়িয়া সেই লিখনটি মৃত্যুঞ্জয়ের প্রায় কণ্ঠস্থ হইয়া গিয়াছিল, তাই এই অনিদ্রাবস্থায় কেবলই তাহার মাথায় ঘুরিতে লাগিল—

পায়ে ধরে সাধা।
রা নাহি দেয় রাধা।
শেষে দিল রা,
পাগোল ছাড়াে পা।

 মাথা গরম হইয়া উঠিল—কোনােমতেই এই কটা ছত্র সে মন হইতে দূর করিতে পারিল না। অবশেষে ভােরের বেলায় যখন তাহার তন্দ্রা আসিল তখন স্বপ্নে এই চারি ছত্রের অর্থ অতি সহজে তাহার নিকট প্রকাশ হইল। ‘রা নাহি দেয় রাধা’ অতএব ‘রাধা'র ‘রা না থাকিলে ‘ধা রহিল—‘শেষে দিল রা’ অতএব হইল ধারা’—‘পাগােল ছাড়ো পা’, ‘পাগােল’-এর ‘পা’ ছাড়িলে ‘গােল’ বাকি রহিল— অতএব সমস্তটা মিলিয়া হইল ‘ধারাগােল’—এ জায়গাটার নাম তাে ধারাগােলই বটে।

 স্বপ্ন ভাঙিয়া মৃত্যুঞ্জয় লাফাইয়া উঠিল।

8

সমস্ত দিন বনের মধ্যে ফিরিয়া সন্ধ্যাবেলায় বহু কষ্টে পথ খুঁজিয়া অনাহারে মৃতপ্রায় অবস্থায় মৃত্যুঞ্জয় গ্রামে ফিরিল।

 পরদিন চাদরে চিঁড়া বাঁধিয়া পুনর্বার সে বনের মধ্যে যাত্রা করিল। অপরাহ্ণে একটা দিঘির ধারে আসিয়া উপস্থিত হইল। দিঘির মাঝখানটা পরিষ্কার জল, আর পাড়ের গায়ে গায়ে চারি দিকে পদ্ম আর কুমুদের বন। পাথরে বাঁধানাে ঘাট ভাঙিয়া-চুরিয়া পড়িয়াছে, সেইখানে জলে চিঁড়া ভিজাইয়া খাইয়া দিঘির চারি দিক প্রদক্ষিণ করিয়া দেখিতে লাগিল।

 দিঘির পশ্চিম পাড়ির প্রান্তে হঠাৎ মৃত্যুঞ্জয় থমকিয়া দাঁড়াইল। দেখিল, একটা