পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গুপ্তধন
৫৫৫

কোনাে ফল হইল না। বারবার মনে হইতে লাগিল, কেন সে কাগজখানা পুড়াইয়া ফেলিলাম—সেখানা রাখিলেই বা ক্ষতি কী ছিল।

 “তখন আবার আমার সেই জন্মগ্রামে গেলাম। আমাদের পৈতৃক ভিটার নিতান্ত দুরবস্থা দেখিয়া মনে করিলাম, আমি সন্ন্যাসী, আমার ধনরত্নে কোনাে প্রয়ােজন নাই, কিন্তু এই গরিবরা তাে গৃহী, সেই গুপ্ত সম্পদ ইহাদের জন্য উদ্ধার করিয়া দিলে তাহাতে দোষ নাই।

 “সেই লিখন কোথায় আছে জানিতাম, তাহা সংগ্রহ করা আমার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন হইল না।

 “তাহার পরে একটি বৎসর ধরিয়া এই কাগজখানা লইয়া এই নির্জন বনের মধ্যে গণনা করিয়াছি আর সন্ধান করিয়াছি। মনে আর-কোনাে চিন্তা ছিল না। যত বারম্বার বাধা পাইতে লাগিলাম ততই উত্তরােত্তর আগ্রহ আরও বাড়িয়া চলিল—উন্মত্তের মতাে অহােরাত্র এই এক অধ্যবসায়ে নিবিষ্ট রহিলাম।

 “ইতিমধ্যে কখন তুমি আমার অনুসরণ করিতেছ তাহা জানিতে পারি নাই। আমি সহজ অবস্থায় থাকিলে তুমি কখনােই নিজেকে আমার কাছে গােপন রাখিতে পারিতে না; কিন্তু আমি তন্ময় হইয়া ছিলাম, বাহিরের ঘটনা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিত না।

 “তাহার পরে, যাহা খুঁজিতেছিলাম আজ এইমাত্র তাহা আবিষ্কার করিয়াছি। এখানে যাহা আছে পথিবীতে কোনাে রাজরাজেশ্বরের ভাণ্ডারেও এত ধন নাই। আর একটিমাত্র সংকেত ভেদ করিলেই সেই ধন পাওয়া যাইবে।

 “এই সংকেতটিই সর্বাপেক্ষা দুরহ। কিন্তু এই সংকেতও আমি মনে-মনে ভেদ করিয়াছি। সেইজন্যই ‘পাইয়াছি’ বলিয়া মনের উল্লাসে চীৎকার করিয়া উঠিয়াছিলাম। যদি ইচ্ছা করি তবে আর এক দণ্ডের মধ্যে সেই স্বর্ণমাণিক্যের ভাণ্ডারের মাঝখানে গিয়া দাঁড়াইতে পারি।”

 মত্যুঞ্জয় শংকরের পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “তুমি সন্ন্যাসী, তােমার তাে ধনের কোনাে প্রয়ােজন নাই—আমাকে সেই ভাণ্ডারের মধ্যে লইয়া যাও। আমাকে বঞ্চিত করিয়াে না।”

 শংকর কহিলেন, “আজ আমার শেষ বন্ধন মুক্ত হইয়াছে। তুমি ঐ যে পাথর ফেলিয়া আমাকে মারিবার জন্য উদ্যত হইয়াছিলে তাহার আঘাত আমার শরীরে লাগে নাই, কিন্তু তাহা আমার মােহাবরণকে ভেদ করিয়াছে। তৃষ্ণার করালমূর্তি আজ আমি দেখিলাম। আমার গুরু পরমহংসদেবের নিগূঢ় প্রশান্ত হাস্য এত দিন পরে আমার অন্তরের কল্যাণদীপে অনির্বাণ আলােকশিখা জ্বালাইয়া তুলিল।”

 মত্যুঞ্জয় শংকরের পা ধরিয়া পুনরায় কাতর স্বরে কহিল, “তুমি মুক্ত পুরুষ, আমি মুক্ত নহি, আমি মুক্তি চাহি না, আমাকে এই ঐশ্বর্য হইতে বঞ্চিত করিতে পারিবে না।”

 সন্ন্যাসী কহিলেন, “বৎস, তবে তুমি তােমার এই লিখনটি লও। যদি ধন খুঁজিয়া লইতে পার তবে লইয়াে।”

 এই বলিয়া তাঁহার যষ্টি ও লিখনপত্র মত্যুঞ্জয়ের কাছে রাখিয়া সন্ন্যাসী চলিয়া গেলেন। মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “আমাকে দয়া করাে, আমাকে ফেলিয়া যাইয়াে না—আমাকে