পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৯৪
গল্পগুচ্ছ

 তখন পাড়ার এক বাড়িতে পরীক্ষা করিয়া উৎসবের বাঁশির বায়না করা হইতেছিল। সেই রসনচৌকিতে সকালবেলাকার করুণ সুরে শরতের নবীন রৌদ্র যেন প্রচ্ছন্ন অশ্রুভারে ব্যথিত হইয়া উঠিতেছিল। কালীপদ তাহাদের বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়াইয়া চুপ করিয়া পথের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার পিতা যে কোনো কাজেই কোথাও যাইতেছেন না, তাহা তাঁহার গতি দেখিয়াই বুঝা যায়— প্রতি পদক্ষেপেই তিনি যে একটা নৈরাশ্যের বোঝা টানিয়া টানিয়া চলিয়াছেন এবং তাহা কোথাও ফেলিবার স্থান নাই, তাহা তাঁহার পশ্চাৎ হইতেও স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল।
 কালীপদ অন্তঃপুরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “মা, আমার সেই পাখা-করা মেম চাই না।”
 মা তখন জাঁতি লইয়া ক্ষিপ্রহস্তে সুপারি কাটিতেছিলেন। তাঁহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। ছেলেতে মায়েতে সেইখানে বসিয়া কী একটা পরামর্শ হইয়া গেল তাহা কেহই জানিতে পারিল না। জাঁতি রাখিয়া ধামা-ভরা কাটা ও অকাটা সুপুরি ফেলিয়া রাসমণি তখনই বগলাচরণের বাড়ি চলিয়া গেলেন।
 আজ ভবানীচরণের বাড়ি ফিরিতে অনেক বেলা হইল। স্নান সারিয়া যখন তিনি খাইতে বসিলেন তখন তাঁহার মুখ দেখিয়া বোধ হইল, আজও দধিপায়সের সদ্গতি হইবে না, এমনকি মাছের মুড়াটা আজ সম্পূর্ণই বিড়ালের ভোগে লাগিবে।
 তখন দড়ি দিয়া মোড়া কাগজের এক বাক্স লইয়া রাসমণি তাঁহার স্বামীর সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিলেন। আহারের পরে যখন ভবানীচরণ বিশ্রাম করিতে যাইবেন তখনই এই রহস্যটা তিনি আবিষ্কার করিবেন, ইহাই রাসমণির ইচ্ছা ছিল, কিন্তু দধি পায়স ও মাছের মুড়ার অনাদর দূর করিবার জন্য এখনই এটা বাহির করিতে হইল। বাক্সের ভিতর হইতে সেই মেম-মূর্তি বাহির হইয়া বিনা বিলম্বে প্রবল উৎসাহে আপন গ্রীষ্মতাপ-নিবারণে লাগিয়া গেল। বিড়ালকে আজ হতাশ হইয়া ফিরিতে হইল। ভবানীচরণ গৃহিণীকে বলিলেন, “আজ রান্নাটা বড়ো উত্তম হইয়াছে। অনেকদিন এমন মাছের ঝোল খাই নাই। আর, দইটা যে কী চমৎকার জমিয়াছে সে আর কী বলিব।”
 সপ্তমীর দিন কালীপদ তাহার অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষার ধন পাইল। সেদিন সমস্ত দিন সে মেমের পাখা-খাওয়া দেখিল, তাহার সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদি্গকে দেখাইয়া তাহাদের ঈর্ষার উদ্রেক করিল। অন্য কোনো অবস্থায় হইলে সমস্তক্ষণ এই পুতুলের একঘেয়ে পাখা-নাড়ায় সে নিশ্চয়ই এক দিনেই বিরক্ত হইয়া যাইত— কিন্তু অষ্টমীর দিনেই প্রতিমা বিসর্জন দিতে হইবে জানিয়া তাহার অনুরাগ অটল হইয়া রহিল। রাসমণি তাঁহার গুরুপুত্রকে দুই টাকা নগদ দিয়া কেবল এক দিনের জন্য এই পুতুলটি ভাড়া করিয়া আনিয়াছিলেন। অষ্টমীর দিনে কালীপদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া স্বহস্তে বাক্সসমেত পুতুলটি বগলাচরণের কাছে ফিরাইয়া দিয়া আসিল। এই এক দিনের মিলনের সুখস্মৃতি অনেকদিন তাহার মনে জাগরুক হইয়া রহিল, তাহার কল্পনালোকে পাখা চলার আর বিরাম রহিল না।
 এখন হইতে কালীপদ মাতার মন্ত্রণার সঙ্গী হইয়া উঠিল এবং এখন হইতে ভবানীচরণ প্রতিবৎসরই এত সহজে এমন মূল্যবান পূজার উপহার কালীপদকে দিতে পারিতেন যে, তিনি নিজেই আশ্চর্য হইয়া যাইতেন।