পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
রাজটিকা
৩৮৯

 কন্‌গ্রেসের বলবৃদ্ধি! হা স্বর্গগত তাত পূর্ণেন্দুশেখর! কন্‌গ্রেসের বলবৃদ্ধি করিবার জন্যই কি তুমি হতভাগাকে ভারতভূমিতে জন্মদান করিয়াছিলে!

 কিন্তু, দুঃখের সঙ্গে সুখও আছে। নবেন্দুর মতো লোক যে-সে লোক নহেন, -তাঁহাকে নিজতীরে তুলিবার জন্য যে এক দিকে ভারতবর্ষীয় ইংরাজসম্পদায় অপর দিকে কন্‌গ্রেস লালায়িতভাবে ছিপ ফেলিয়া অনিমিষলোচনে বসিয়া আছে, এ কথাটা নিতান্ত ঢাকিয়া রাখিবার কথা নহে। অতএর নবেন্দু হাসিতে হাসিতে কাগজখানা লইয়া লাবণ্যকে দেখাইলেন। কে লিখিয়াছে যেন কিছুই জানে না, এমনি ভাবে লাবণ্য আকাশ হইতে পড়িয়া কহিল, “ওমা, এ যে সমস্তই ফাঁস করিয়া দিয়াছে! আহা! আহা! তোমার এমন শত্রু, কে ছিল! তাহার কলমে যেন ঘুণ ধরে, তাহার কালিতে যেন বালি পড়ে, তাহার কাগজ যেন পোকায় কাটে-”

 নবেন্দু হাসিয়া কহিল, “আর অভিশাপ দিয়ো না। আমি আমার শত্রুকে মার্জনা করিয়া আশীর্বাদ করিতেছি, তাহার সোনার দোয়াত-কলম হয় যেন।”

 দুইদিন পরে কন্‌গ্রেসের বিপক্ষপক্ষীয় একখানা ইংরাজসম্পাদিত ইংরাজি কাজ ডাকযোগে নবেন্দুর হাতে আসিয়া পৌঁছিলে পড়িয়া দেখিলেন, তাহাতে ‘One who knows’ স্বাক্ষরে পূর্বোক্ত সংবাদের প্রতিবাদ বাহির হইয়াছে। লেখক লিখিতেছেন যে, নবেন্দুকে যাহারা জানেন তাহারা তাহার নামে এই দুর্নামরটনা কখনোই বিশ্বাস করিতে পারেন না; চিতাবাঘের পক্ষে নিজ চর্মের কৃষ্ণ অঙ্কগুলির পরিবর্তন যেমন অসম্ভব নবেন্দুর পক্ষেও কন্‌গ্রেসের দলবৃদ্ধি করা তেমনি। বাবু নবেন্দুশেখরের যথেষ্ট নিজস্ব পদার্থ আছে, তিনি কর্মশূন্য উমেদার ও মক্কেলশূন্য আইনজীবী নহেন। তিনি দুইদিন বিলাতে ঘুরিয়া বেশভূষা-আচারব্যবহারে অদ্ভুত কপিবৃত্তি করিয়া স্পর্ধাভরে ইংরাজ-সমাজে প্রবেশোদ্যত হইয়া অবশেষে ক্ষুণ্নমনে হতাশভাবে ফিরিয়া আসেন নাই, অতএব কেন যে তিনি এই সকল-ইতাদি ইত্যাদি।

 হা পরলোকগত পিতঃ পুর্ণেন্দুশেখর! ইংরাজের নিকট এত নাম; এত বিশ্বাস সঞ্চয় করিয়া তবে তুমি মরিয়াছিলে।

 এ চিঠিখনিও শ্যালীর নিকট পেখমের মতো বিস্তার করিয়া ধরিবার যোগ্য। ইহার মধ্যে একটা কথা আছে যে, নবেন্দু অখ্যাত অকিঞ্চন লক্ষ্মীছাড়া নহেন, তিনি সারবান পদার্থবান লোক।

 লাবণ্য পুনশ্চ আকাশ হইতে পড়িয়া কহিল, “এ আবার তোমার কোন্ পরমবন্ধু লিখিল! কোন্ টিকিট-কালেক্টর, কোন্ চামড়ার দালাল, কোন্ গড়ের বাদ্যের বাজনদার!”

 নীলরতন কহিল, “এ চিঠির একটা প্রতিবাদ করা তো তোমায় উচিত।”

 নবেন্দু কিছু উঁচু চালে বলিল, “দরকার কী। যে যা বলে তাহারই কি প্রতিবাদ করিতে হইবে।”

 লাবণ্য উচ্চৈঃস্বরে চারি দিকে একেবারে হাসির ফোয়ারা ছড়াইয়া দিল।

 নবেন্দু অপ্রতিভ হইয়া কহিল, “এত হাসি যে”।

 তাহার উত্তৱে লাবণ্য পুনর্বার অনিবার্য বেগে হাসিয়া পুষ্পিতযৌবনা দেহলতা লুণ্ঠিত করিতে লাগিল।

 নবেন্দু নাকে মুখে চোখে এই প্রচুর পরিহাসের পিচকারি খাইয়া অত্যন্ত নাকাল