পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৮৯

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৩০০
গল্পগুচ্ছ

বাবু বুঝি মনে মনে আমাদের প্রতি অবজ্ঞা অনুভব করিতেছেন। আমি রাগ করিতাম এবং ভাবিতাম, অবজ্ঞার যোগ্য কে। যে লোক সমস্ত জীবন কঠোর ত্যাগস্বীকার করিয়া, নানা প্রলোভন অতিক্রম করিয়া, লোকমুখের তুচ্ছ খ্যাতি অবহেলা করিয়া, অশ্রান্ত এবং সতর্ক বুদ্ধি -কৌশলে সমস্ত প্রতিকূল বাধা প্রতিহত করিয়া, সমস্ত অনুকূল অবসরগুলিকে আপনার আয়ত্তগত করিয়া একটি একটি রৌপ্যের স্তরে সম্পদের একটি সমুচ্চ পিরামিড একাকী স্বহস্তে নির্মাণ করিয়া গিয়াছেন, তিনি হাঁটুর নীচে কাপড় পরিতেন না বলিয়া যে কম লোক ছিলেন তাহা নয়।

 তখন বয়স অল্প ছিল, সেইজন্য এইরূপ তর্ক করিতাম, রাগ করিতাম। এখন বয়স বেশি হইয়াছে; এখন মনে করি, ক্ষতি কী। আমার তো বিপুল বিষয় আছে, আমার কিসের অভাব। যাহার কিছু নাই, সে যদি অহংকার করিয়া সুখী হয়, তাহাতে আমার তো সিকি পয়সার লোকসান নাই, বরং সে বেচারার সান্ত্বনা আছে।

 ইহাও দেখা গিয়াছে, আমি ব্যতীত আর কেহ কৈলাসবাবুর উপর রাগ করিত না। কারণ এত বড়ো নিরীহ লোক সচরাচর দেখা যায় না। ক্রিয়াকর্মে সুখে দুঃখে প্রতিবেশীদের সহিত তাঁহার সম্পূর্ণ যোগ ছিল। ছেলে হইতে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলকেই দেখা হইবামাত্র তিনি হাসিমুখে প্রিয়সম্ভাষণ করিতেন—যেখানে যাহার যে-কেহ আছে সকলেরই কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়া তবে তাঁহার শিষ্টতা বিরাম লাভ করিত। এইজন্য কাহারও সহিত তাঁহার দেখা হইলে একটা সুদীর্ঘ প্রশ্নোত্তরমালার সষ্টি হইত—“ভালো তো? শশী ভালো আছে? আমাদের বড়োবাবু ভালো আছেন? মধুর ছেলেটির জ্বর হয়েছিল শুনেছিলাম, সে এখন ভালো আছে তো? হরিচরণবাবুকে অনেককাল দেখি নি, তাঁর অসুখবিসুখ কিছু হয় নি? তোমাদের রাখালের খবর কী। বাড়ির এঁয়ারা সকলে ভালো আছেন?” ইত্যাদি।

 লোকটি ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কাপড়চোপড় অধিক ছিল না, কিন্তু মের্‌জাইটি চাদরটি জামাটি, এমন-কি বিছানায় পাতিবার একটি পুরাতন র‍্যাপার, বালিশের ওয়াড়, একটি ক্ষুদ্র সতরঞ্চ, সমস্ত স্বহস্তে রৌদ্রে দিয়া, ঝাড়িয়া, দড়িতে খাটাইয়া, ভাঁজ করিয়া, আলনায় তুলিয়া, পরিপাটি করিয়া রাখিতেন। যখনই তাঁহাকে দেখা যাইত তখনই মনে হইত যেন তিনি সুসজ্জিত প্রস্তুত হইয়া আছেন। অল্পস্বল্প সামান্য আস্‌বাবেও তাঁহার ঘর সমুজ্জ্বল হইয়া থাকিত। মনে হইত যেন তাঁহার আরও অনেক আছে।

 ভৃত্যাভাবে অনেক সময় ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া তিনি নিজের হস্তে অতি পরিপাটি করিয়া ধুতি কোঁচাইতেন এবং চাদর ও জামার আস্তিন বহু যত্নে ও পরিশ্রমে গিলে করিয়া রাখিতেন। তাঁহার বড়ো বড়ো জমিদারি ও বহুমূল্যের বিষয়-সম্পত্তি লোপ পাইয়াছে, কিন্তু একটি বহুমূল্য গোলাপপাশ, আতরদান, একটি সোনার রেকাবি, একটি রুপার আলবোলা, একটি বহুমূল্য শাল ও সেকেলে জামাজোড়া ও পাগড়ি দারিদ্র্যের গ্রাস হইতে বহু চেষ্টায় তিনি রক্ষা করিয়াছিলেন। কোনো-একটা উপলক্ষ উপস্থিত হইলে এইগুলি বাহির হইত এবং নয়নজোড়ের জগদ্‌বিখ্যাত বাবুদের গৌরব রক্ষা হইত।

 এ দিকে কৈলাসবাবু, মাটির মানুষ হইলেও কথায় যে অহংকার করিতেন সেটা যেন পূর্বপুরুষদের প্রতি কর্তব্যবোধে করিতেন; সকল লোকেই তাহাতে প্রশ্রয় দিত