পাতা:গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৯৬

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
গল্পগুচ্ছ
৩০৭

প্রতিহিংসা

প্রথম পরিচ্ছেদ

মুকুন্দবাবুদের ভূতপূর্ব দেওয়ানের পৌত্রী, বর্তমান ম্যানেজারের স্ত্রী ইন্দ্রাণী অশুভক্ষণে বাবুদের বাড়িতে তাঁহাদের দৌহিত্রের বিবাহে বউভাতের নিমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন।

 তৎপূর্বকার ইতিহাস সংক্ষেপে বলিয়া রাখিলে কথাটা পরিষ্কার হইবে।

 এক্ষণে মুকুন্দবাবুও ভূতপূর্ব, তাঁহার দেওয়ান গৌরীকান্তও ভূতপূর্ব; কালের আহ্বান অনুসারে উভয়ের কেহই স্বস্থানে সশরীরে বর্তমান নাই। কিন্তু যখন ছিলেন তখন উভয়ের মধ্যে বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। পিতৃমাতৃহীন গৌরীকান্তের যখন কোনো জীবনোপায় ছিল না, তখন মুকুন্দলাল কেবলমাত্র মুখ দেখিয়া তাঁহাকে বিশ্বাস করিয়া তাঁহার উপরে নিজের ক্ষুদ্র বিষয়সম্পত্তি পর্যবেক্ষণের ভার দেন। কালে প্রমাণ হইল যে, মুকুন্দলাল ভুল করেন নাই। কীট যেমন করিয়া বল্মীক রচনা করে, স্বর্গকামী যেমন করিয়া পুণ্য সঞ্চয় করে, গৌরীকান্ত তেমনি করিয়া অশ্রান্ত যত্নে তিলে তিলে দিনে দিনে মুকুন্দলালের বিষয় বৃদ্ধি করিতে লাগিলেন। অবশেষে যখন তিনি কৌশলে আশ্চর্য সুলভ মূল্যে তরফ বাঁকাগাড়ি ক্রয় করিয়া মুকুন্দলালের সম্পত্তিভূক্ত করিলেন, তখন হইতে মুকুন্দবাবুরা গণ্যমান্য জমিদার-শ্রেণীতে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। প্রভুর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ভৃত্যেরও উন্নতি হইল; অল্পে অল্পে তাঁহার কোঠাবাড়ি জোতজমা এবং পূজার্চনা বিস্তার লাভ করিল। এবং যিনি এক কালে সামান্য তহশিলদার-শ্রেণীর ছিলেন, তিনিও সাধারণের নিকট দেওয়ানজি নামে পরিচিত হইলেন।

 ইহাই ভূতপূর্ব কালের ইতিহাস। বর্তমান কালে মুকুন্দবাবুর একটি পোষ্যপুত্র আছেন, তাঁহার নাম বিনোদবিহারী। এবং গৌরীকান্তের সুশিক্ষিত নাতজামাই অম্বিকাচরণ তাঁহাদের ম্যানেজারের কাজ করিয়া থাকেন। দেওয়ানজি তাঁহার পুত্র রামকান্তকে বিশ্বাস করিতেন না—সেইজন্য বার্ধক্যবশত নিজে যখন কাজ ছাড়িয়া দিলেন তখন পুত্রকে লঙ্ঘন করিয়া নাতজামাই অম্বিকাকে আপন কার্যে নিযুক্ত করিয়া দিলেন।

 কাজকর্ম বেশ চলিতেছে; পূর্বের আমলে যেমন ছিল এখনও সকলই প্রায় তেমনি আছে, কেবল একটা বিষয়ে একটু প্রভেদ ঘটিয়াছে—এখন প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক কেবল কাজকর্মের সম্পর্ক, হৃদয়ের সম্পর্ক নহে। পূর্বকালে টাকা সস্তা ছিল এবং হৃদয়টাও কিছু সুলভ ছিল, এখন সর্বসম্মতিক্রমে হৃদয়ের বাজে খরচটা একপ্রকার রহিত হইয়াছে; নিতান্ত আত্মীয়ের ভাগেই টানাটানি পড়িয়াছে, তা বাহিরের লোকে পাইবে কোথা হইতে।

 ইতিমধ্যে বাবুদের বাড়িতে দৌহিত্রের বিবাহে বউভাতের নিমন্ত্রণে দেওয়ানজির পৌত্রী ইন্দ্রাণী গিয়া উপস্থিত হইল।

 সংসারটা কৌতূহলী অদৃষ্টপুরুযের রাসায়নিক পরীক্ষাশালা। এখানে কতকগুলো বিচিত্রচরিত্র মানুষ একত্র করিয়া তাহাদেয় সংযোগ-বিয়োগে নিরত কত চিত্রবিচিত্র