পাতা:গল্পগুচ্ছ (প্রথম খণ্ড).djvu/১৩৮

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৩৪
গল্পগুচ্ছ

হতবুদ্ধিভাবে সংসারের স্পর্শ পরিত্যাগ করিয়া দুলিয়া দুলিয়া বেড়াইতেছে। যাহা-কিছু করিতেছে তাহা যেন আর-একজন কে করাইতেছে। ঠিক যেন পুংলাবাজির দোদুল্যমান পুতুলগুলির মতো। তাই কাহারও মুখে ভাব নাই, ভাবনা নাই, সকলেই নিরতিশয় গম্ভীর চালে যথানিয়মে চলাফেরা করিতেছে। অথচ সবসুদ্ধ ভারি অদ্ভুত দেখাইতেছে।

 চারি দিকে এই জীবন্ত নির্জীবতার পরমগম্ভীর রকম-সকম দেখিয়া রাজপুত্র আকাশে মুখ তুলিয়া হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। এই আন্তরিক কৌতুকের উচ্চ হাস্যধ্বনি তাসরাজ্যের কলরবহীন রাজপথে ভারি বিচিত্র শুনাইল। এখানে সকলই এমনি একান্ত যথাযথ, এমনি পরিপাটি, এমনি প্রাচীন, এমনি সুগম্ভীর যে, কৌতুক আপনার অকস্মাৎ-উচ্ছ্বসিত উচ্ছৃঙ্খল শব্দে আপনি চকিত হইয়া, ম্লান হইয়া, নির্বাপিত হইয়া গেল— চারি দিকের লোকপ্রবাহ পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ স্তব্ধ গম্ভীর অনুভূত হইল।

 কোটালের পুত্র এবং সদাগরের পুত্র ব্যাকুল হইয়া রাজপুত্রকে কহিল, “ভাই সাঙাত, এই নিরানন্দ ভূমিতে আর এক দণ্ড নয়। এখানে আর দুই দিন থাকিলে মাঝে মাঝে আপনাকে স্পর্শ করিয়া দেখিতে হইবে জীবিত আছি কিনা।”

 রাজপুত্র কহিল, “না ভাই, আমার কৌতূহল হইতেছে। ইহারা মানুষের মতো দেখিতে— ইহাদের মধ্যে এক-ফোটা জীবন্ত পদার্থ আছে কিনা একবার নাড়া দিয়া দেখিতে হইবে।”

 এমনি তো কিছুকাল যায়। কিন্তু, এই তিনটে বিদেশী যুবক কোনো নিয়মের মধ্যেই ধরা দেয় না। যেখানে যখন ওঠা, বসা, মুখ ফেরানো, উপুড় হওয়া, চিৎ হওয়া, মাথা নাড়া, ডিগবাজি খাওয়া উচিত, ইহারা তাহার কিছুই করে না; বরং সকৌতুকে নিরীক্ষণ করে এবং হাসে। এই-সমস্ত যথাবিহিত অশেষ ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যে-একটি দিগগজ গাম্ভীর্য আছে ইহারা তাদ্বারা অভিভূত হয় না।

 একদিন টেক্কা সাহেব গোলাম আসিয়া রাজপুত্র, কোটালের পুত্র এবং