পাতা:গল্পগুচ্ছ (প্রথম খণ্ড).djvu/১৮০

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৭৬
গল্পগুচ্ছ

ব্যগ্রদৃষ্টি এই জনতার উপরে অজস্র নিপতিত হইতেছে। একবার একাগ্রভাৰে চিত্তকে সেই উর্ধলোকে উৎক্ষিপ্ত করিয়া আপনার জয়লক্ষ্মীকে বন্দনা করিয়া আসিলেন; মনে-মনে কহিলেন, “আমার যদি আজ জয় হয় তবে, হে দেবী, হে অপরাজিতা, তাহাতে তোমারই নামের সার্থকতা হইবে।”

 তুরী ভেরি বাজিয়া উঠিল। জয়ধ্বনি করিয়া সমাগত সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। শুক্লবসন রাজা উদয়নারায়ণ শরৎপ্রভাতের শুভ্র মেঘরাশির ন্যায় ধীরগমনে সভায় প্রবেশ করিলেন এবং সিংহাসনে উঠিয়া বসিলেন।

 পুণ্ডরীক উঠিয়া সিংহাসনের সম্মুখে আসিয়া দাড়াইলেন। বৃহৎ সভা স্তব্ধ হইয়া গেল।

 বক্ষ বিস্ফারিত করিয়া, গ্রীবা ঈষৎ উর্ধ্বে হেলাইয়া, বিরাটমূর্তি পুণ্ডরীক গম্ভীরম্বরে উদয়নারায়ণের স্তব পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন। কণ্ঠস্বর ঘরে ধরে না— বৃহৎ সভাগৃহের চারি দিকের ভিত্তিতে স্তম্ভে ছাদে সমুদ্রের তরঙ্গের মতো গম্ভীর মন্দ্রে আঘাত প্রতিঘাত করিতে লাগিল, এবং কেবল সেই ধ্বনির বেগে সমস্ত জনমণ্ডলীর বক্ষকবাট থর্‌থর্‌ করিয়া স্পন্দিত হইয়া উঠিল। কত কৌশল, কত কারুকার্য, উদয়নারায়ণ নামের কতরূপ ব্যাখ্যা, রাজার নামাক্ষরের কত দিক হইতে কতপ্রকার বিন্যাস, কত ছন্দ, কত যমক।

 পুণ্ডরীক যখন শেষ করিয়া বসিলেন কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ সভাগৃহ তাহার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি ও সহস্র হৃদয়ের নির্বাক বিস্ময়রাশিতে গম্‌ গম্‌ করিতে লাগিল। বহু দূরদেশ হইতে আগত পণ্ডিতগণ দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া উচ্ছসিত স্বরে ‘সাধু সাধু’ করিয়া উঠিলেন।

 তখন সিংহাসন হইতে রাজা একবার শেখরের মুখের দিকে চাহিলেন। শেখরও ভক্তি প্রণয় অভিমান এবং একপ্রকার সকরুণ সংকোচপূর্ণ দৃষ্টি রাজার দিকে প্রেরণ করিল এবং ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল। রাম যখন লোকরঞ্জনার্থে দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষা করিতে চাহিয়াছিলেন তখন সীতা যেন এইরূপভাবে চাহিয়া এমনি করিয়া তাঁহার স্বামীর সিংহাসনের সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিলেন।

 কবির দৃষ্টি নীরবে রাজাকে জানাইল, “আমি তোমারই। তুমি যদি বিশ্বসমক্ষে আমাকে দাঁড় করাইয়া পরীক্ষা করিতে চাও তো করো। কিন্তু—” তাহার পরে নয়ন নত করিলেন।