পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মহামায়া ఏ&9 আপনার স্বভাবের চারি দিকে একটা আবরণ লইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছে—তাহার পর মাঝে আবার যেন আর-একবার জন্মগ্রহণ করিয়া আবার আরও একটা আবরণ লইয়া আসিয়াছে। অহরহ পাবে থাকিয়াও সে এত দরে চলিয়া গিয়াছে যে, রাজীব যেন আর তাহার নাগাল পায় না— কেবল একটা মায়াগন্ডির বাহিরে বসিয়া অতৃপ্ত তৃষিত হৃদয়ে এই সক্ষম অথচ অটল রহস্য ভেদ করিবার চেষ্টা করিতেছে— নক্ষত্র যেমন প্রতিরাত্রি নিদ্রাহীন নিনিমেষ নত নেত্রে অন্ধকার নিশীথিনীকে ভেদ করিবার প্রয়াসে নিম্ফলে নিশিযাপন করে। এমনি করিয়া এই দুই সঙ্গীহীন একক প্রাণী কতকাল একত্র যাপন করিল। একদিন বর্ষাকালে শুক্লপক্ষ দশমীর রাত্রে প্রথম মেঘ কাটিয়া চাঁদ দেখা দিল । নিপন্দ জ্যোৎসনারান্ত্ৰি সতে পথিবীর শিয়রে জাগিয়া বসিয়া রহিল। সে রাত্রে নিদ্রা ত্যাগ করিয়া রাজীবও আপনার জানালায় বসিয়া ছিল । গ্রীষ্মমক্লিন্ট বন হইতে একটা গন্ধ এবং ঝিল্লির শ্রান্তরব তাহার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিতেছিল। রাজীব দেখিতেছিল, অন্ধকার তরশ্রেণীর প্রান্তে শান্ত সরোবর একখানি মাজিত রপোর পাতের মতো ঝকঝকা করিতেছে। মানুষ এরকম সময় পষ্ট একটা কোনো কথা ভাবে কি না বলা শক্ত। কেবল তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ একটা কোনো দিকে প্রবাহিত হইতে থাকে— বনের মতো একটা গন্ধোচ্ছদাস দেয়, রাত্রির মতো একটা ঝিল্লিধবনি করে। রাজীব কী ভাবিল জানি না কিন্তু তাহার মনে হইল, আজ যেন সমস্ত পাব নিয়ম ভাঙিয়া গিয়াছে। আজ বর্ষারাত্রি তাহার মেঘাবরণ খুলিয়া ফেলিয়াছে এবং আজিকার এই নিশাঁথিনীকে সেকালের সেই মহামায়ার মতো নিস্তব্ধ সন্দের এবং সুগম্ভীর দেখাইতেছে । তাহার সমস্ত অস্তিত্ব সেই মহামায়ার দিকে একযোগে ধাবিত হইল। স্বপনচালিতের মতো উঠিয়া রাজীব মহামায়ার শয়নমন্দিরে প্রবেশ করিল। মহামায়া তখন ঘুমাইতেছিল। রাজ্ঞীর কাছে গিয়া দাঁড়াইল-– মুখ নত করিয়া দেখিল— মহামায়ার মুখের উপর জোংলা আসিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু, হায়, এ কী ! সে চিরপরিচিত মুখ কোথায় । চিতানলশিখা তাহার নিষ্ঠর লেলিহান রসনায় মহামায়ার বামগণ্ড হইতে কিয়দংশ সৌন্দয একেবারে লেহন করিয়া লইয়া আপনার ক্ষুধার চিহ্ন রাখিয়া গেছে। বোধ করি রাজীব চমকিয়া উঠিয়াছিল, বোধ করি একটা অব্যন্ত ধর্মনিও তাহার মখ দিয়া বাহির হইয়া থাকিবে। মহামায়া চমকিয়া জাগিয়া উঠিল; দেখিল, সমখে রাজীল । তৎক্ষণাং ঘোমটা টানিয়া শয্যা ছাড়িয়া একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইল । রাজীব বঝিল এইবার বঞ্জ উদ্যত হইয়াছে। ভূমিতে পড়িল ; পায়ে ধরিয়া কহিল, “আমাকে ক্ষমা করো।” মহামায়া একটি উত্তরমান্ত না করিয়া, মহোতের জন্য পশ্চাতে না ফিরিয়া, ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। রাজীবের ঘরে আর সে প্রবেশ করিল না। কোথাও তাহার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। সেই ক্ষমাহীন চিরবিদায়ের নীরব ক্রোধানল রাজীবের সমস্ত ইহজীবনে একটি সদেীঘ দখচিহ্ন রাখিয়া দিয়া গেল। ফাগন ১২১১