পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ১৭৫ অসম্পভব কথা এক যে ছিল রাজা। তখন ইহার বেশি কিছ জানিবার আবশ্যক ছিল না। কোথাকার রাজা, রাজার নাম কী, এ-সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া গল্পের প্রবাহ রোধ করিতাম না। রাজার নাম শিলাদিত্য কি শালিবাহন, কাশী কান্টি কনোজ কোশল অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের মধ্যে ঠিক কোনখানটিতে তাঁহার রাজত্ব, এ-সকল ইতিহাস-ভূগোলের তক আমাদের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ ছিল; আসল যে কথাটি শুনিলে অন্তর পলকিত হইয়া উঠিত এবং সমস্ত হৃদয় এক মহেতের মধ্যে বিদদেবেগে চুবকের মতো আকৃষ্ট হইত সেটি হইতেছে— এক যে ছিল রাজা । এখনকার পাঠক যেন একেবারে কোমর বধিয়া বসে। গোড়াতেই ধরিয়া লয়, লেখক মিথ্যা কথা বলিতেছে। সেইজন্য অত্যন্ত সেয়ানার মতো মুখ করিয়া জিজ্ঞাসা করে, “লেখকমহাশয়, তুমি যে বলিতেছ এক যে ছিল রাজা, আচ্ছা বলো দেখি কে ছিল সেই রাজা ।” লেখকেরাও সেয়ানা হইয়া উঠিয়াছে; তাহারা প্রকাণ্ড প্রত্নতত্ত্ব-পণ্ডিতের মতো মুখমণ্ডল চতুগণ মণ্ডলাকার করিয়া বলে, “এক যে ছিল রাজা তাহার নাম ছিল অজাতশত্র।” পাঠক চোখ টিপিয়া জিজ্ঞাসা করে, “অজাতশত্ৰ ! ভালো, কোন অজাতশত্র বলো দেখি । লেখক অবিচলিত মুখভাব ধারণ করিয়া বলিয়া যায়, “অজাতশত্র ছিল তিনজন। একজন খৃস্টজন্মের তিন সহস্ৰ বৎসর পতবে জন্মগ্রহণ করিয়া দুই বৎসর আট মাস বয়ঃক্রমকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। দুঃখের বিষয়, তাঁহার জীবনের বিস্তারিত বিবরণ কোনো গ্রন্থেই পাওয়া যায় না।” অবশেষে দ্বিতীয় অজাতশত্র সম্বন্ধে দশজন ঐতিহাসিকের দশ বিভিন্ন মত সমালোচনা শেষ করিয়া যখন গ্রন্থের নায়ক তৃতীয় অজাতশত্রর পর্যন্ত আসিয়া পৌছায় তখন পাঠক বলিয়া উঠে, “ওরে বাস রে, কী পাণ্ডিত্য। এক গল্প শুনিতে আসিয়া কত শিক্ষাই হইল। এই লোকটাকে আর অবিশ্ববাস করা যাইতে পারে না । আচ্ছা লেখকমহাশয়, তার পরে কী হইল।” হায় রে হায়, মানুষ ঠকিতেই চায়, ঠকিতেই ভালোবাসে, অথচ পাছে কেহ নিবোধ মনে করে এ ভয়টনকুও ষোলো আনা আছে। এইজন্য প্রাণপণে সেয়ানা হইবার চেষ্টা করে। তাহার ফল হয় এই যে, সেই শেষকালটা ঠকে, কিন্তু বিস্তর আড়ম্বর করিয়া ঠকে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়ো না, তাহা হইলে মিথ্যা জবাব শানিতে হইবে না। বালক সেইটি বোঝে, সে কোনো প্রশ্ন করে না। এইজন্য রপেকথার সন্দের মিথ্যাটাকু শিশুর মতো উলঙ্গ, সত্যের মতো সরল, সদ্য-উৎসাবিত উৎসের মতো স্বচ্ছ; আর এখনকার দিনের সচেতুর মিথ্যা মুখোশ-পরা মিথ্যা। কোথাও যদি তিলমাত্র ছিদ্র থাকে আমনি ভিতর হইতে সমস্ত ফাঁক ধরা পড়ে, পাঠক বিমুখ হয়, লেখক পালাইবার পথ পায় না।