পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৭৮ গল্পগুচ্ছ রানী তো সে দিন বহয় যত্নে চৌষট্টি ব্যঞ্জন বহস্তে রাঁধলেন এবং সমস্ত সোনার থালে ও রপার বাটিতে সাজাইয়া চন্দনকাঠের পি’ড়ি পাতিয়া দিলেন। রাজকন্যা চামর হাতে করিয়া দাঁড়াইলেন। রাজা আজ বারো বৎসর পরে অন্তঃপরে ফিরিয়া আসিয়া খাইতে বসিলেন। রাজকন্যা রপে আলো করিয়া দাঁড়াইয়া চামর করিতে লাগিলেন। মেয়ের মাখের দিকে চান আর রাজার খাওয়া হয় না। শেষে রানীর দিকে চাহিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাঁ গো রানী, এমন সোনার প্রতিমা লক্ষমীঠাকরনটির মতো এ মেয়েটি কে গা । এ কাহাদের মেয়ে ।” রানী কপালে করাঘাত করিয়া কহিলেন, "হা আমার পোড়া কপাল। উহাকে চিনিতে পারিলে না ? ও ষে তোমারই মেয়ে।” রাজা বড়ো আশচষ হইয়া বলিলেন, “আমার সেই সেদিনকার এতটুকু মেয়ে আজ এত বড়োটি হইয়াছে!” রানী দীঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “তা আর হইবে না! বল কী, আজ বারো বৎসর হইয়া গেল।” রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “মেয়ের বিবাহ দাও নাই ?” রানী কহিলেন, “তুমি ঘরে নাই, উহার বিবাহ কে দেয়। আমি কি নিজে পাত্র খুজিতে বাহির হইব।” রাজা শুনিয়া হঠাৎ ভারি শশব্যস্ত হইয়া উঠিলা বলিলেন, “বোসো, আমি কাল সকালে উঠিয়া রাজবারে যাহার মুখ দেখিব তাহারই সহিত উহার বিবাহ দিয়া দিব।” রাজকন্যা চামর করিতে লাগিলেন। তাঁহার হাতের বালাতে চুড়িতে ঠুং ঠাং শব্দ হইতে লাগিল। রাজার আহার হইয়া গেল । পরদিন ঘমে হইতে উঠিয়া বাহিরে আসিয়া রাজা দেখিলেন, একটি ব্রাহরণের ছেলে রাজবাড়ির বাহিরে জঙ্গল হইতে শুকনা কাঠ সংগ্ৰহ করিতেছে। তাহাব বয়স বছর সাত-আট হইবে। রাজা বলিলেন, “ইহারই সহিত আমার মেযের বিবাহ দিব।" রাজার হঝুেম কে লঙ্ঘন করিতে পারে, তখনই ছেলেটিকে ধরিয়া তাহার সহিত রাজকন্যার মালা-বদল করিয়া দেওয়া হইল । আমি এই জায়গাটাতে দিদিমার খবে কাছ ঘেষিয়া নিরতিশয় ঔৎসক্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলাম, “তার পরে ?” নিজেকে সেই সাত-আট বৎসরের সৌভাগ্যবান কাঠকুড়ানে ব্রাহরণের ছেলের স্থলাভিষিক্ত করিতে কি একটুখানি ইচ্ছা যায় নাই। যখন সেই রাত্রে ঝাপ ঝাপ বষ্টি পড়িতেছিল, মিট মিট করিয়া প্রদীপ জলিতেছিল এবং গন গন বরে দিদিমা মশারির মধ্যে গল্প বলিতেছিলেন, তখন কি বালকহৃদয়ের বিশ্বাসপরায়ণ রহস্যময় অনাবিকৃত এক ক্ষুদ্র প্রান্তে এমন একটি অত্যন্ত সম্ভবপর ছবি জাগিয়া উঠে নাই যে, সেও একদিন সকালবেলায় কোথায় এক রাজার দেশে রাজার দরজায় কাঠ কুড়াইতেছে, হঠাৎ একটি সোনার প্রতিমা লক্ষীঠাকরনটির মতো রাজকন্যার সহিত তাহার মালা-বদল হইয়া গেল; মাথায় তাহার সিথি, কানে তাহার দল, গলায় তাহার কন্ঠী, হাতে তাহার কাঁকন, কটিতে তাহার চন্দ্রহার, এবং