পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૭૦ গল্পগুচ্ছ কক্ষটি হেমশশীকে সেইরাপ সবগমরীচিকা দেখাইয়া আকষণ করিত। সে গভীর রাত্রে একাকিনী জাগিয়া বসিয়া সেই আদর বাতায়নের আলোক ছায়া ও সংগীত এবং আপন মনের আকাঙ্ক্ষা ও কল্পনা লইয়া একটি মায়ারাজ্য গড়িয়া তুলিত, এবং আপন মানসপত্তেলিকাকে সেই মায়াপুরীর মাঝখানে বসাইয়া বিস্মিত বিমাধনেত্রে নিরীক্ষণ করিত, এবং আপন জীবন-যৌবন সুখ-দঃখ ইহকাল-পরকাল সমস্তই বাসনার অঙ্গারে ধাপের মতো পড়াইয়া সেই নিজন নিস্তব্ধ মন্দিরে তাহার প্রজা করিত। সে জানিত না, তাহার সম্মুখবতী ঐ হম'বাতায়নের অভ্যন্তরে ঐ তরঙ্গিত প্রমোদপ্রবাহের মধ্যে এক নিরতিশয় ক্লান্তি, গলানি, পঙ্কিলতা, বীভৎস ক্ষুধা এবং প্রাণক্ষয়কর দাহ আছে। ঐ বীতনিদ্র নিশাচর আলোকের মধ্যে যে এক হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার কুটিলহাস্য প্রলয়ক্ৰীড়া করিতে থাকে, বিধবা দরে হইতে তাহা দেখিতে পাইত না । হেম আপন নিজন বাতায়নে বসিয়া তাহার এই মায়াসবগ এবং কল্পিত দেবতাটিকে লইয়া চিরজীবন সবপনাবেশে কাটাইয়া দিতে পারিত, কিন্তু দুভাগ্যক্লমে দেবতা অনুগ্রহ করিলেন এবং সবগ নিকটবতী হইতে লাগিল । সবগ যখন একেবারে পথিবীকে আসিয়া পশ করিল তখন সবগ ও ভাঙিয়া গেল এবং যে ব্যক্তি এতদিন একলা বসিয়া সবগ গড়িয়াছিল সেও ভাঙিয়া ধুলিসাৎ হইল । এই বাতায়নবাসিনী মগধ বালিকাটির প্রতি কখন মোহিতের লালয়িত দটি পড়িল, কখন তাহাকে বিনোদচন্দ্র’-নামক মিথ্যা সবােক্ষরে বারবার পত্র লিখিয়া অবশেষে একখানি সশঙ্ক উৎকণ্ঠিত অশুদ্ধ বানান ও উচ্ছসিত হৃদযাবেগ -প,ণ উত্তর পাইল, এবং তাহার পর কিছুদিন ঘাতপ্রতিঘাতে উল্লাসে-সংকোচে সন্দেহে-সম্প্রমে আশায়-আশঙ্কায় কেমন করিয়া ঝড় বহিতে লাগিল, তাহার পবে প্রলয়সমুখোন্মত্ততায় সমস্ত জগৎসংসার বিধবার চারি দিকে কেমন করিয়া ঘুরিতে লাগিল, এবং ঘুরিতে ঘুরিতে ঘৃণনবেগে সমস্ত জগৎ অমলেক ছায়ার মতো কেমন করিয়া অদশ্য হইয়া গেল, এবং অবশেষে কখন একদিন অকস্মাং সেই ঘণমান সংসারচক্র হইতে বেগে বিচ্ছিন্ন হইয়া রমণী অতি দরে বিক্ষিপত হইয়া পড়িল সে সকল বিবরণ বিস্তারিত করিয়া বলিবার আবশ্যক দেখি না। একদিন গভীর রাত্রে পিতা মাতা ভ্রাতা এবং গ্রহ ছাড়িয়া হেমশশী বিনোদচন্দ্রছদ্মনামধারী মোহিতের সহিত এক গাড়িতে উঠিয়া বসিল । দেবপ্রতিমা যখন তাহার সমস্ত মাটি এবং খড় এবং রাংতার গহনা লইয়া তাহার পাশের আসিয়া সংলগ্ন হইল, তখন সে লক্ষজায় ধিক্কারে মাটিতে মিশিয়া গেল । অবশেষে গাড়ি যখন ছাড়িয়া দিল তখন সে কাদিয়া মোহিতের পায়ে ধরিল ; বলিল, “ওগো, পায়ে পড়ি আমাকে আমাব বাড়ি রেখে এসো।” মোহিত শশব্যস্ত হইয়া তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল। গাড়ি দ্রুতবেগে চলিতে লাগিল। জলনিমগ্ন মরণাপন্ন ব্যক্তির যেমন মহোতের মধ্যে জীবনের সমস্ত ঘটনাবলী পষ্ট মনে পড়ে, তেমনি সেই বাররাধ গাড়ির গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে হেমপশীর